৪. ক্রিয়া পদ কাকে বলে? উহা কত প্রকার ও কি কি?

যে পদ দিয়ে কোন কাজ করা বোঝায়, তাকে ক্রিয়া পদ বলে
অর্থাৎ, বাক্যের অন্তর্গত যে পদ দ্বারা কোন কাজ সম্পাদন করা বা কোন কাজ সংঘটন হওয়াকে বোঝায়, তাকে ক্রিয়া পদ বলে
ক্রিয়ামূল বা ধাতুর সঙ্গে পুরুষ কাল অনুযায়ী ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়। যেমন, ‘পড়্একটি ধাতু। এর সঙ্গে উত্তম পুরুষ সাধারণ বর্তমান কাল অনুযায়ীপ্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত হয়পড়িক্রিয়াপদটি। আবার মধ্যম পুরুষের জন্য হবেপড়ো নাম পুরুষের জন্য হবেপড়ে আবার উত্তম পুরুষের
জন্য ঘটমান বর্তমান কালের জন্য হবেপড়ছি সাধারণ অতীত কালের জন্য হবেপড়েছি
[ক্রিয়া পদ বাক্যের অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু ক্রিয়াপদ নিয়ে একটি বাক্য গঠিত হতে পারে। কিন্তু ক্রিয়া পদ ছাড়া কোন বাক্য গঠিত হতে পারে না। তবে মাঝে মাঝে অনেক বাক্যের ক্রিয়াপদটি উহ্য থাকে। যেমন- ‘রমেশ আমার ভাই (হয়)এই বাক্যেহয়ক্রিয়াটি উহ্য থাকে, এটি না লিখলেও সবাই বুঝতে পারে। আর তাই এটি লেখাও হয় না। কিন্তু এটা আবার ইংরেজি করলেহয়’- ইংরেজি লেখা হয়- Ramesh is my brother.
সাধারণত, ‘হ্ আছ্ধাতু বা ক্রিয়ামূল দ্বারা গঠিত ক্রিয়া পদগুলো উহ্য থাকে।]
ক্রিয়ার প্রকারভেদ
. সমাপিকা-অসমাপিকা ক্রিয়া
বাক্যের ভাব প্রকাশের উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াপদকে সমাপিকা ক্রিয়া অসমাপিকা ক্রিয়া, এই দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে
সমাপিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়া পদ বাক্যের ভাবের পরিসমাপ্তি ঘটায়, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, যে ক্রিয়া পদ বাক্যকে সম্পূর্ণ করে, আর কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা বাকি থাকে না, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে
একটি বাক্যে একটি সমাপিকা ক্রিয়া থাকতেই হয় এবং একটি বাক্যে একটার বেশি সমাপিকা ক্রিয়া থাকতে পারে না যেমন-
·         ছেলেরা খেলছে ছেলেরা খেলা করছে
দ্বিতীয় বাক্যেখেলাসমাপিকা ক্রিয়া নয়। জন্যকরছেসমাপিকা ক্রিয়া আনতে হয়েছে। নয়তো বাক্যটি সম্পূর্ণ হচ্ছে না
অসমাপিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়া পদ দ্বারা বাক্যের ভাবের পরিসমাপ্তি ঘটে না, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, যে ক্রিয়া দ্বারা বাক্য সম্পূর্ণ হয় না, আরো কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে
অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহারের পরও বাক্যে সমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করতে হয়। শুধু অসমাপিকা ক্রিয়া দিয়ে বাক্য গঠিত হয় না
একটি বাক্যে যতোগুলো ইচ্ছা অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করা যায়। কিন্তু একটি সমাপিকা ক্রিয়া আনতেই হয়। যেমন-
·         ছেলেরা খেলা
এখানে খেলা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া। ক্রিয়া পদ হলেও এটি দিয়ে বাক্যটি সম্পূর্ণ হয়নি, আরো কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যাচ্ছে। এর সঙ্গে আরেকটি সমাপিকা ক্রিয়াকরছেযোগ করলেই কেবল বাক্যটি সম্পূর্ণ হবে
·         ছেলেরা খেলা করছে
সাধারণত অসমাপিকা ক্রিয়ার শেষে ইয়া, ইলে, ইতে, , লে, তে বিভক্তিগুলো যুক্ত থাকে
. সকর্মক-অকর্মক-দ্বিকর্মক ক্রিয়া
বাক্যে ক্রিয়ার কর্মের উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াপদকে অকর্মক, সকর্মক দ্বিকর্মক- এই ভাগে ভাগ করা হয়
কর্ম পদ : যে পদকে আশ্রয় করে ক্রিয়া পদ তার কাজ সম্পাদন বা সংঘটন করে, তাকে কর্ম পদ বলে। অর্থাৎ, ক্রিয়া পদ কাজ করার জন্য যেই পদকে ব্যবহার করে, তাকে কর্ম পদ বলে
ক্রিয়া পদকেকী/ কাকেদিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায়, সেটিই কর্মপদ আর যদি উত্তর না পাওয়া যায়, তবে সেই ক্রিয়ার কোন কর্মপদ নেই যেমন-
·         মেয়েটি কলম কিনেছে
·         মেয়েটি হাসে
এখানে প্রথম বাক্যে ক্রিয়াপদকিনেছেকেকীদিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায়কলম (কী কিনেছে?- কলম) অর্থাৎ, প্রথম বাক্যের ক্রিয়ার কর্মপদ কলম
আবার দ্বিতীয় বাক্যের ক্রিয়াপদহাসেকেকী/ কাকেকোনটা দিয়ে প্রশ্ন করলেই কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং, এই বাক্যের ক্রিয়াপদের কোন কর্ম নেই
অকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়াপদের কোন কর্ম নেই তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে
সকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়াপদের কর্ম পদ আছে তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে
দ্বিকর্মক ক্রিয়া : কখনো কখনো একটি বাক্যে একই ক্রিয়াপদের দুটি কর্ম পদ থাকে। তখন সেই ক্রিয়াপদকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে। এক্ষেত্রেবস্তুবাচক কর্মপদকে প্রধান বা মুখ্য কর্ম বলে এবং ব্যক্তিবাচক কর্মপদকে গৌণ কর্ম বলে। অর্থাৎ, বস্তুবাচক কর্মটিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। যেমন- ‘বাবা আমাকে একটি ল্যাপটপ কিনে দিয়েছেন।
এখানেকিনে দিয়েছেনক্রিয়ার কর্মপদ দুটি, ‘আমাকে’ (কাকে কিনে দিয়েছেন?) ল্যাপটপ’ (কী কিনে দিয়েছেন?) এখানে বস্ত্তবাচক কর্মপদল্যাপটপ’, আর ব্যক্তিবাচক কর্মপদআমাকে সুতরাং এখানে মুখ্য বা প্রধান কর্মপদল্যাপটপআর গৌণ বা অপ্রধান কর্মআমাকে
সমধাতুজ কর্ম : বাক্যের ক্রিয়াপদ কর্মপদ যদি একই ধাতু বা ক্রিয়ামূল থেকে গঠিত হয়, তবে তাকে সমধাতুজ কর্মপদ বলে অর্থাৎ, ক্রিয়াপদ কর্মপদ একই শব্দমূল থেকে গঠিত হলে তাকে সমধাতুজ কর্মপদ বলে যেমন-
·         আজ এমন ঘুম ঘুমিয়েছি
এখানে ক্রিয়াপদঘুমিয়েছি’, আর কর্মপদঘুম’ (কী ঘুমিয়েছি?) আর এইঘুমিয়েছিআরঘুমদুটি শব্দেরই শব্দমূলঘুম্ অর্থাৎ, শব্দ দুইটি একই ধাতু হতে গঠিত (ক্রিয়ার মূলকে ধাতু বলে) সুতরাং, এই বাক্যেঘুমকর্মটি একটি সমধাতুজ কর্ম। এরকম-
·         আজ কী খেলা খেললাম। (খেল্)
·         আর মায়াকান্না কেঁদো না। (কাঁদ্)
·         এমন মরণ মরে কয়জনা? (মর্)
. প্রযোজক ক্রিয়া
যে ক্রিয়া একজনের প্রযোজনায় আরেকজন করে তাকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে
প্রযোজক ক্রিয়ার দুজন কর্তা থাকে। এরমধ্যে একজন কর্তা কাজটি আরেকজন কর্তাকে দিয়ে করান। অর্থাৎ, একজন যখন আরেকজনকে দিয়ে কোন কাজ করিয়ে নেয়, তখন সেই ক্রিয়াপদটিকে বলে প্রযোজক ক্রিয়া। [সংস্কৃত ব্যাকরণে এরই নাম ণিজন্ত ক্রিয়া।]
প্রযোজক ক্রিয়ার দুইজন কর্তার মধ্যে যিনি কাজটি করান, তাকে বলে প্রযোজক কর্তা। আর যিনি কাজটি করেন, তাকে বলে প্রযোজ্য কর্তা। তাকে দিয়ে কাজটি প্রযোজ্য করা হয় বলে তাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে। যেমন-
·         মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন
এখানে চাঁদ দেখার কাজটি করছেশিশু’, কিন্তু চাঁদ দেখাচ্ছেনমা অর্থাৎ, ‘মাকাজটি প্রযোজনা করছেন। তাইমাএখানে প্রযোজক কর্তা। আর চাঁদ দেখার কাজটি আসলেশিশুকরছে, তাইশিশুএখানে প্রযোজ্য কর্তা। এরকম-
·         সাপুড়ে সাপ খেলায়। (এখানে সাপুড়ে প্রযোজক কর্তা, আর সাপ প্রযোজ্য কর্তা)
. নামধাতুর ক্রিয়া
বিশেষ্য, বিশেষণ ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরেপ্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে সব ধাতু গঠিত হয়, তাদেরকে নামধাতু বলে। নামধাতুর সঙ্গে ক্রিয়াবিভক্তি যুক্ত হয়ে যেসব ক্রিয়াপদ গঠন করে, তাদেরকেই নামধাতুর ক্রিয়া বলে
যেমন-
·         বিশেষ্য = বেত+ = বেতা, ক্রিয়াপদ = বেতানো, বেতাচ্ছেন, বেতিয়ে
·         বিশেষণ = বাঁকা+ = বাঁকা, ক্রিয়াপদ = বাঁকানো, বাঁকাচ্ছেন, বাঁকিয়ে
·         ধ্বন্যাত্মক অব্যয় = কন কন+ = কনকনা, ক্রিয়াপদ = কনকনাচ্ছে, কনকনিয়ে
বাক্যে প্রয়োগ- লোকটি ছেলেটিকে বেতাচ্ছে
·         কঞ্চিটি বাঁকিয়ে ধর
·         দাঁত ব্যথায় কনকনাচ্ছে। অজগরটি ফোঁসাচ্ছে
ব্যতিক্রম : কয়েকটি নামধাতুপ্রত্যয় ছাড়াই ধাতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
·         ফল = বাগানে এবার অনেক আম ফলেছে
·         টক = তরকারি বাসি হলে টকে
·         ছাপা = প্রকাশক তার বইটা এবার মেলায় ছেপেছে
. যৌগিক ক্রিয়া
একটি সমাপিকা ক্রিয়া একটি অসমাপিকা ক্রিয়া পাশাপাশি বসে যদি কোন বিশেষ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে, তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। অর্থাৎ, একটি সমাপিকা একটি অসমাপিকা ক্রিয়া মিলে যদি তাদের সাধারণ অর্থ প্রকাশ না করে কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। যেমন-
·         ঘটনাটা শুনে রাখ। (শোনার বদলে তাগিদ দেয়া অর্থ বুঝিয়েছে)
·         তিনি বলতে লাগলেন। (বলার অর্থ সম্প্রসারণ করে নিরন্তর বলা বুঝিয়েছে)
·         ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়ল। (শোওয়ার পাশাপাশি দিনের কার্যসমাপ্তিও বোঝাচ্ছে)
·         সাইরেন বেজে উঠল। (আকস্মিক সাইরেন বাজার কথা বলা হচ্ছে)
·         শিক্ষায় মন সংস্কারমুক্ত হয়ে থাকে। (অভ্যস্ততা অর্থে, ধীরে ধীরে সংস্কারমুক্ত হয় বোঝাচ্ছে)
·         এখন যেতে পার। (যাওয়ার বদলে অনুমোদন অর্থে)
. মিশ্র ক্রিয়া
বিশেষ্য, বিশেষণ ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সঙ্গে কর্, হ্, দে, পা, যা, কাট্, গা, ছাড়্, ধর্, মার্, প্রভৃতি ধাতু যোগ হয়ে ক্রিয়াপদ গঠন করে কোন বিশেষ অর্থ প্রকাশ করলে তাকে মিশ্র ক্রিয়া বলে। যেমন-
বিশেষ্যের পরে :
·         আমরা তাজমহল দর্শন করলাম
·         গোল্লায় যাও
বিশেষেণের পরে :
·         তোমাকে দেখে বিশেষ প্রীত হলাম
ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে :
·         মাথা ঝিম ঝিম করছে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে
[খেয়াল রাখতে হবে, যৌগিক ক্রিয়া দুইটি ক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়, যার একটি সমাপিকা ক্রিয়া আরেকটি অসমাপিকা ক্রিয়া। অন্যদিকে, মিশ্র ক্রিয়া বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের পরে ক্রিয়াপদ বসে গঠিত হয়।]
পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপ
পুরুষ
সাধারণ
সম্ভ্রমাত্মক
তুচ্ছার্থক/ ঘনিষ্ঠার্থক
উত্তম পুরুষ
আমি যাই
আমরা যাই
———
——–
মধ্যম পুরুষ
তুমি যাও
তোমরা যাও
আপনি যান
আপনারা যান
তুই যা
তোরা যা
নাম পুরুষ
সে যায়
তারা যায়
তিনি যান
তাঁরা যান
এটা যায়
এগুলো যায়
[উত্তম পুরুষ : বাক্যের বক্তাই উত্তম পুরুষ। অর্থাৎ, যেই ব্যক্তি বাক্যটি বলেছে, সেই উত্তম পুরুষ। উত্তম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- আমি, আমরা, আমাকে, আমাদের, ইত্যাদি
মধ্যম পুরুষ : বাক্যের উদ্দিষ্ট শ্রোতাই মধ্যম পুরুষ। অর্থাৎ, উত্তম পুরুষ যাকে উদ্দেশ্য করে বাক্যটি বলে, এবং পাশাপাশি বাক্যেও উল্লেখ করে, তাকে মধ্যম পুরুষ বলে। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষভাবে উদ্দিষ্ট শ্রোতাই মধ্যম পুরুষ। মধ্যম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- তুমি, তোমরা, তোমাকে, তোমাদের, তোমাদিগকে, আপনি, আপনার, আপনাদের, ইত্যাদি
নামপুরুষ : বাক্যে বক্তা অনুপস্থিত যেসব ব্যক্তি, বস্ত্ত বা প্রাণীর উল্লেখ করেন, তাদের নামপুরুষ বলে। অর্থাৎ, বক্তার সামনে নেই এমন যা কিছুর কথা বক্তা বাক্যে বলেন, সবগুলোই নামপুরুষ। নাম পুরুষের সর্বনামের রূপ হলো- সে, তারা, তাহারা, তাদের, তাহাকে, তিনি, তাঁকে, তাঁরা, তাঁদের, ইত্যাদি।]

No comments

Powered by Blogger.