138. বাংলাদেশে যানজট সমস্যা ও তার প্রতিকার
ভূমিকা: জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে পরিচিত। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এদেশে বর্তমানে অন্যতম একটি সমস্যা হলো ট্রাফিক জ্যাম বা যানজট। এদেশের বিভিন্ন শহরে যানজট দেখা দিলেও রাজধানী শহর ঢাকায় তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যানজটের তীব্রতায় অতিষ্ঠ হয়ে ঢাকা শহরের অধিবাসীরা চরম দুর্ভোগের শিকার। রাজধানীর গতিময় যান্ত্রিক জীবন থমকে দাঁড়ায় যানজটের কারণে।
যানজট কী: সাধারণভাবে যানজট হলো রাস্তার কোনো কাজ, দুর্ঘটনা, ভারী নির্মাণমূলক কাজে গাড়ির নিশ্চল অবস্থা অথবা খুব মন্থর গতিতে দীর্ঘক্ষণ ধরে এলোমেলোভাবে চলা। পৃথিবীর সকল দেশেই কমবেশি ট্রাফিক জ্যাম বা যানজট পরিলক্ষিত হয়। উন্নত দেশের তুলনায় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে যানজটের আধিক্য
লক্ষণীয়। যানজট নাগরিক জীবনে এক তীব্র যন্ত্রণার নাম। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নগর জীবন যেন এই যন্ত্রণার প্রতিবিম্ব।
বাংলাদেশে যানজট: বাংলাদেশের ছোট বড় প্রায় সকল শহরেই কমবেশি যানজট সমস্যাটি দৃশ্যমান হয়। তবে রাজধানী ঢাকাতে যানজটে জনজীবন একেবারে বিপর্যস্ত। রাজধানীর বাইরে অন্যান্য শহরগুলোতে যানজট তীব্র না হলেও বিশেষ সময়ে ও বিশেষ কারণে কখনো কখনো মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে যানজট প্রত্যক্ষ করা যায়। রাস্তার মেরামত কাজ, বর্ষাকালে রাস্তায় খানাখন্দের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয়। এদেশের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব ঈদের সময় সারাদেশে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। অনুন্নত রাস্তাঘাট, দেশীয় অনুন্নত গাড়ী, রাস্তায় রেলক্রসিং এর কারণেও যানজট তৈরি হয়। তবে শহরগুলোতে যানজট সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল এ সমস্যা থেকে মুক্ত।
ঢাকা শহরে যানজট ও কারণ: ঢাকা বিশ্বের একটি অন্যতম জনবহুল শহর। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হওয়ায় এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। দেশের অন্যান্য শহরের চেয়ে এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি হবার ফলে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ঢাকায় নিত্য বসতি স্থাপন করছে। বিশাল এ জনসংখ্যার প্রয়োজনে প্রতিনিয়ত ঢাকায় যোগ হচ্ছে নতুন নতুন যানবাহন। কিন্তু যানবাহন ও লোকসংখ্যার তুলনায় রাস্তাঘাট বাড়ছে না। বিপরীতে অধিক জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে রাস্তাঘাট কমে যাচ্ছে। অত্যধিক জনসংখ্যা ও যানবাহনের চাপ অপর্যাপ্ত রাস্তা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অসহনীয় যানজট। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে কোনো রকম নিয়মনীতি বা আইনের তোয়াক্কা না করেই যত্রতত্র দালান-কোঠা, কল-কারখানা গড়ে উঠছে। রাজধানীতে যেখানে-সেখানে গাড়ি পাকিং এখন নিত্য ব্যাপার। যা যানজট বৃদ্ধিতে অন্যতম সহায়ক, ড্রাইভারদের আইন না মানার প্রবণতা, আগে যাবার প্রবণতা যানজট বৃদ্ধিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। পাশাপাশি বিভিন্ন রাস্তায় রয়েছে অসাধু ট্রাফিক পুলিশের দৌরাত্ম্য। ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান আরেকটি কারণ হলো অপর্যাপ্ত পাবলিক বাস। পক্ষান্তরে প্রয়োজনের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস এ সমস্যাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। পথচারীরাও আইন না মেনে ইচ্ছামতো রাস্তা পার হয় ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে। একই রাস্তায় দ্রুতগতির গাড়ি ও নিম্নগতির রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা চলার কারণেও সৃষ্টি হয় যানজটের। এছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আন্দোলন, মিছিল-মিটিং এ সমস্যাকে আরো প্রকট করে তুলছে।
যানজটের ক্ষতিকর দিক: আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন দ্রুত গতির যানবাহন আবিষ্কার সন্দেহাতীতভাবেই জীবনকে গতিশীল করলেও যানজট সেই গতিতে ফিরিয়ে এনেছে স্থবিরতা। যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়। সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে কষ্ট হয়। এতে হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে তড়িঘড়ি করার কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি যথাসময়ে জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে পৌঁছাতে পারে না। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সবাইকেই এর দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
যানজটের আর্থিক ক্ষতি: আমেরিকার টেক্সাস ট্রান্সপোর্ট ইনস্টিটিউট-এর এক গবেষণায় দেখা যায় আমেরিকা প্রতিবছর যানজটের কারণে প্রায় ১১০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ইউরোপে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এর এক বিবৃতিতে দেখা যায় ইউরোপে প্রতিবছর ২০০ বিলিয়ন ইউরোর চেয়েও বেশি অর্থ যানজটের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের তিন প্রকৌশলীর বর্ণনামতে ঢাকা শহরে যানজটের কারণে যে ক্ষতি হয় তার আর্থিক মূল্য প্রতিবছর প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এভাবে যানজটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্ব ও জাতীয় অর্থনীতি।
যানজট নিরসনের উপায়: যানজট নিরসনে বাংলাদশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফ্লাইওভার, ওভার ব্রীজ নির্মাণ করে রাস্তার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। পরিকল্পনা করা হচ্ছে মেট্রোরেল ও উড়াল সেতু নির্মাণের। অধিকাংশ রাস্তাগুলোকে পাকা সড়কে রূপান্তর করা হচ্ছে। অনুন্নত ভাঙা ও খানাখন্দকপূর্ণ সড়কগুলোকে মেরামত করা হচ্ছে। তবে রাস্তাঘাটকে যানজট মুক্ত করতে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
১। ছোট রাস্তাগুলোকে যথাসম্ভব দীর্ঘ ও প্রশস্ত করতে হবে।
২। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে হবে।
৩। লাইসেন্স বিহীন যানবাহন বা অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
৪। ট্রাফিক আইন আরো কার্যকরী ও ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। ব্যস্ততম রাস্তায় রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং বন্ধ করতে হবে।
৬। অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করতে হবে।
৭। রাস্তাগুলোকে বহু লেন বিশিষ্ট করে ধীর গতির ও দ্রুত গতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। ঢাকা শহরে প্রাইভেট গাড়ির বদলে পাবলিক বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯। বিভাগীয় শহরগুলোতে ঢাকা শহরের মতো উন্নয়ন অবকাঠামো বিস্তৃত করতে হবে।
১০। ঢাকা শহরের বাইরেও নামী-দামী স্কুল কলেজ স্থাপন করতে হবে।
১১। বিভাগীয় শহরেও উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্র, হোটেল, রেস্তোরাঁর ব্যবস্থা করতে হবে।
১২। মিনিবাসের সংখ্যা কমিয়ে ডাবল ডেকার বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৩। রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত ডিভাইডারের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৪। বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ব্যাপক কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সবাই শহরে জড়ো না হয়।
১৫। রাজধানী ঢাকার রাস্তা থেকে অবৈধ হকারদের উচ্ছেদ করতে হবে।
১৬। রেল যোগাযোগ ও নৌ-যোগাযোগের উন্নতি সাধন করতে হবে।
১৭। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যাতায়াতে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হবে।
১৮। প্রাইভেট গাড়ি কিনতে নিরুৎসাহিত করতে উচ্চহারে ভ্যাট নির্ধারণ করতে হবে।
উপসংহার: যানজট জনজীবনে শুধু অস্বস্তি আর দুর্ভোগের কারণ নয় বরং তা অর্থনৈতিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়। অধিক যানজট বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। তাই আধুনিক গতিময় জীবনকে আরো গতিশীল করতে যানজটমুক্ত জীবনের কোনো বিকল্প নেই। তাই যানজট নিরসনে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
No comments