139. বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট ও তার প্রতিকার
ভূমিকা: বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মধ্যে বিদ্যুৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ১৮৩৩ সালে মাইকেল ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতার গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়েছেন। বিদ্যুৎ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে করেছে গতিশীল ও উন্নত। মানব সভ্যতার সর্বক্ষেত্র আজ বিদ্যুতের ছোঁয়ায় আলোকিত। বিদ্যুতের আবিষ্কারে পৃথিবীর সব অন্ধকার যেনো দূর হয়ে গেল মানুষের চোখের সামনে থেকে। বিদ্যুৎ বর্তমান সভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সংকট রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যহত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বিদ্যুৎ সংকটের প্রতিকার আশু প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ ও আধুনিক সমাজ: আধুনিক সমাজ বিদ্যুতের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ ছাড়া বর্তমানে মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। বিদ্যুৎকে কেন্দ্র করেই আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি গড়ে উঠেছে। বৈদ্যুতিক বাতি, বৈদ্যুতিক পাখা, রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, চিকিৎসাক্ষেত্রে ই. সি. জি., এক্সরে প্রভৃতি
বিদ্যুতের কারণেই আবিষ্কৃত হয়েছে। ইমেইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ সাইটও বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। বর্তমান সমাজ বিদ্যুৎ ছাড়া এক পা-ও নড়তে পারে না।
বিদ্যুৎ সংকট ও প্রতিক্রিয়া: বিদ্যুতের সংকট সৃষ্টি হলে মানুষের গতিশীল জীবন থমকে দাঁড়ায়। স্থবির হয়ে যায় মানুষের উৎপাদনমুখী কর্মকান্ড। ফলে অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। বিদ্যুৎ না থাকলে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে জনজীবন, দুর্ভোগ নেমে আসে মানুষের জীবনে। শিল্প-কারখানা, হাসপাতাল, বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক বাতি, রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার চরম ব্যাঘাত ঘটে।
উন্নত দেশে বিদ্যুৎ সংকট: বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মূল চালিকাশক্তি বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ও উন্নতি বন্ধ হয়ে যায়। তাই উন্নত দেশে বিদ্যুৎ সংকট নেই বললেই চলে। সে সব দেশে বিদ্যুৎ সংকট অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় ব্যাপার। যদি কোনোক্রমে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় তবে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষকে জনসাধারণের নিকট জবাবদিহি করতে হয়।
অনুন্নত দেশে বিদ্যুৎ সংকট: অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিদ্যুৎ ঘাটতি খুব বেশি। এ ঘাটতির কারণেই এসব দেশের শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে না, উৎপাদনমুখী কর্মকা- ব্যাহত হচ্ছে, জীবনযাত্রার মান শোচনীয় রূপ ধারণ করছে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিম্ন থেকে নিম্নতর হচ্ছে। তারা বিদ্যুতের অভাবে উন্নতির পথে আসতে পারে না।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকট সর্বদা পরিলক্ষিত হয়। এ সংকটের কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, কৃষি কাজ প্রভৃতি আজ হুমকির মুখে। বিদ্যুতের অভাবে মানুষের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ১০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন, সেখানে উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৬০০০ মেগাওয়াট। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন কম এবং উৎপাদিত বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার না হওয়া বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের কারণ: বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের নানাবিদ কারণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো-
-বাংলাদেশের পুরাতন বৈদ্যুতিক প্লান্টগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
- নতুন নতুন বৈদ্যুতিক প্লান্ট স্থাপনের অভাব।
- বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ও অপচয়।
- বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় অদক্ষ ব্যবস্থাপনা।
- নতুন বৈদ্যুতিক প্লান্ট স্থাপনে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির অভাব।
- জলবিদ্যুৎ ও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতি অনাগ্রহ।
- বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের যথাযথ পরিকল্পনার অভাব।
- গ্যাস ও কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে গ্যাস ও কয়লার অপ্রতুলতা।
- রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জটিলতাও বিদ্যুৎ সংকটের জন্য দায়ী।
বিদ্যুৎ সংকট প্রতিকারের উপায়: আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার করা যেতে পারে। খরস্রোতা নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। বর্তমানে রূপান্তরিত গ্যাস হচ্ছে বিদ্যুতের প্রধান জ্বালানি। কিন্তু জাতীয় গ্যাস উৎপাদন ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। তাই স্থলভাগ এবং সাগর হতে আমাদেরকে আরো বেশি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে হবে। আমাদের দেশের পশ্চিম অঞ্চল উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লায় সমৃদ্ধ। বিশ্বে কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান জ্বালানি। তাই বড় পুকুরিয়া, ফুলবাড়িয়া খনি থেকে প্রচুর পরিমাণ কয়লা উৎপাদন করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনো কারণ ছাড়াই এ দিক থেকে পিছিয়ে আছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারমাণবিক বৈদ্যুতিক প্লান্ট স্থাপন করা খুবই জরুরি। জাতীয় চাহিদা পূরণের জন্য সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। আমাদের দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা লাঘবের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলোও গ্রহণ করা যেতে পারে-
- দেশের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন বৈদ্যুতিক প্লান্ট স্থাপন করা।
- পুরাতন বৈদ্যুতিক প্লান্টগুলির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
- বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত জ্বালানী সরবরাহ করা।
- অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং অপচয় রোধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
- উৎপাদিত বিদ্যুতের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা।
- বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।
- প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার বর্জন করা এবং বসতবাড়ি, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, শিল্পকারখানা ইত্যাদিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া।
- বিদ্যুৎ জালিয়াতির সাথে যুক্ত অসাধু চক্রকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া।
- আঞ্চলিকভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে।
- বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছে না। এদের জরিমানাসহ বিল আদায়ের ব্যবস্থা করা।
- রাজনীতির কবল থেকে বিদ্যুৎ বিভাগকে মুক্ত রাখা।
এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন বেসরকারি মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে সরকারের সাথে সহযোগিতা করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভূমিকা পালন করতে হবে।
বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ: দেশের বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে বর্তমান সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তন্মধ্যে ভারত ও চীনের সাথে যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এর ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর হবে। বর্তমানে দেশে ২৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকার ২০২১ সালের মধ্যেই দেশের সকল মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ লক্ষ্যে সরকার জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সংযোজন করেছে।
সাল
|
মেগাওয়াট
|
সাল
|
মেগাওয়াট
|
সাল
|
মেগাওয়াট
|
২০০৮
|
৩৫০
|
২০১০
|
১৭৮৫
|
২০১২
|
১৯৭৫
|
২০০৯
|
১১৯০
|
২০১১
|
১১৭০
|
২০১৩
|
৪৫০
|
সারণি: অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সংযোজন
বর্তমান সরকার সম্প্রতি ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করেছে। চীনের সাথে যৌথ উদ্যোগে পটুয়াখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ১০,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এতে বাংলাদেশের মানুষের বিদ্যুৎ সমস্যা লাঘব হবে।
উপসংহার: বিদ্যুৎ আমাদের প্রাত্যহিক ও জাতীয় জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা অচল। তাই আমাদের জীবনকে গতিশীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
No comments