137. মুক্তবাজার অর্থনীতি
ভূমিকা: অর্থনীতিতে বাজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বাজার সম্পর্কিত ধারণা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। পণ্যবাজার, মুদ্রাবাজার, শ্রমবাজার ইত্যাদি ধারণাগুলোও অর্থনীতির ধারার ক্রমাবর্তনের ফসল। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সময়ে সারাবিশ্বের বাজার নিয়ন্ত্রক হিসেবে ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে। এ বাজার ব্যবস্থাটি নিয়ে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও গণতান্ত্রিক বিশ্বে ধারণাটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
বাজার অর্থনীতি: মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে আলোচনার পূর্বে বাজার অর্থনীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা আবশ্যক। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের শুরুতেই উৎপাদনের উপাদান তথা উৎপাদন, বণ্টন, বিনিময়, ভোগ ইত্যাদি বিষয় জড়িত ছিল। উৎপাদনের উপাদানগুলোকে ঘিরেই মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকা- বৃদ্ধি
পেতে শুরু করে। সমাজের তাগিদেই সৃষ্টি হয় বাজার ব্যবস্থার। অর্থাৎ বাজার হলো অর্থনীতির বিকাশের একটি পর্যায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই বাজার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই মানুষের উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। যাকে বাজার অর্থনীতি নামে অভিহিত করা হয়। এই বাজার অর্থনীতি এমন এক ধরণের ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন হয় বিক্রয়ের জন্য এবং উৎপাদনকারী বিক্রয়ে চূড়ান্তভাবে সর্বোচ্চ মুনাফা প্রত্যাশী।
পেতে শুরু করে। সমাজের তাগিদেই সৃষ্টি হয় বাজার ব্যবস্থার। অর্থাৎ বাজার হলো অর্থনীতির বিকাশের একটি পর্যায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এই বাজার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই মানুষের উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। যাকে বাজার অর্থনীতি নামে অভিহিত করা হয়। এই বাজার অর্থনীতি এমন এক ধরণের ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদন হয় বিক্রয়ের জন্য এবং উৎপাদনকারী বিক্রয়ে চূড়ান্তভাবে সর্বোচ্চ মুনাফা প্রত্যাশী।
মুক্তবাজার অর্থনীতি কি: ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ এমন এক ধরণের বাজার ব্যবস্থা যেখানে সরকার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে ব্যক্তি তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারে। এটাকে কেউ কেউ পুঁজিবাদী অর্থনীতি হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকে। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিশেষ অধিকার রক্ষিত হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল উপাদান হলো পণ্য ক্রয়ে ক্রেতার নিজস্ব পছন্দের অধিকার। আবার পণ্য ও শ্রম বিক্রয়ে এবং ব্যবসা কাটামোতে উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। কোনো রকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা বাধ্যবাধকতা না থাকায় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল ব্যবসায়ে আগ্রহী হয়। বাজারে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়কালে প্রতিযোগিতার কারণে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা থেকেই উৎপত্তি হয় মুক্তবাজার অর্থনীতি।
মুক্তবাজার অর্থনীতির বিবর্তন: উৎপাদন ও বিনিময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থেকেই বাজার অর্থনীতির উদ্ভব হয়েছিল। বাজার অর্থনীতির আধুনিক ও পরিবর্তিত রূপ হলো মুক্তবাজার অর্থনীতি। বাজার ব্যবস্থা বিকাশের গোড়ার দিকে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা সরকার কঠোরভাবে বিভিন্ন পন্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সর্বপ্রথম আঠারো শতকের শেষের দিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যবসার অনুমতি দেয় 'Allow to do' নামে প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে। এ ব্যাপরটি ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশ শতকে ইউরোপে মুক্তবাজার ধারণাটি গ্রহণ করা হয় যা 'Laissez faire policy' নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী 'Free Enterprise Economy' নামে ধারণাটি সমাদৃত হয়। বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু হয়।
মুক্তবাজার অর্থনীতির স্বরূপ: মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজারকে কেন্দ্র করে সে দেশের পণ্যের গুণগতমান, ক্রয়-বিক্রয় এবং মূল্য নির্ধারিত হয়। এ ব্যবস্থায় সাধারণ ব্যক্তিবর্গের ভোক্তা, শ্রমিক এবং বিনিয়োগকারী হিসেবে নিযুক্ত থাকা আবশ্যক। ভোক্তাদের ক্রয়ের ইচ্ছার উপর উৎপাদন প্রভাবিত হয়। বিনিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে এবং শ্রমিকরা নিজেই কাজের সন্ধান করে। এ ব্যবস্থায় পণ্য ও সেবা বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থল হলো বাজার। উৎপাদিত পণ্য ও সেবার চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। মুক্তবাজার ধারণায় ব্যক্তি তার দক্ষতার কারণে উচ্চতর আয় দাবি করতে পারে। এই পদ্ধতিতে সরকার সরাসরি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না তবে সংশ্লিষ্ট সকলের স্বার্থরক্ষায় সরকার বাজার রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং আইন তৈরি করে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্য সম্পর্কিত ধারণা: ব্যবসা মাত্রই সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের প্রচেষ্টা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সঠিক পদ্ধতিতে এ লাভ অর্জিত হয় এবং ভোক্তাও লাভবান হয়ে থাকে। মুক্তবাজার ব্যবস্থায় উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত পক্ষগুলো স্বতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এমনকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সকল বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণরূপে অর্থমূল্যে বিচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে মালিক, শ্রমিক, শ্রম, মেধা, কর্মদক্ষতা সবকিছুকেই বাজার অনুযায়ী পণ্যমূল্যে বা অর্থমূল্যে বিচার করা হয়ে থাকে। শ্রম, মেধা, কর্মদক্ষতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলেও মুক্তবাজার ব্যবস্থায় তা অস্বীকৃত। যার কোনো অর্থমূল্য নেই তাকে শ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাই এ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে নারীর গৃহস্থালির কাজ, সন্তান ধারণ ও লালন-পালন, গৃহ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কর্ম অনুৎপাদনশীল শ্রম হিসেবে বিবেচিত। যদিও তা সভ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসা, সাহিত্যকর্ম, যৌনকর্ম, মানবিক কাজ ইত্যাদি বিষয়গুলোকেও ব্যবসায়িক উপযোগিতার দৃষ্টিকোণে দেখা হয়। এক কথায় মুক্তবাজার ব্যবস্থায় সবকিছুই অর্থমূল্যে বিবেচ্য।
ইতিবাচক দিক: বর্তমান বিশ্বে মুক্তবাজার ব্যবস্থাটি একটি আধুনিক ও আদর্শতম ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। এতে চাহিদা ও যোগানের উপর নির্ভর করে পণ্য সমাগম হওয়ার কারণে বাজারে অধিক পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়। ফলে ক্রেতা নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী পণ্য বাছাই ও ক্রয় করতে পারে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার হওয়ার কারণে পণ্যমূল্যও কম হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিতে ভোক্তার সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায় এবং ভোক্তা অধিকার রক্ষিত হয়। মুক্তবাজার ব্যবস্থা ভোক্তাদের অনুকূলে থাকে। সবকিছুকে অর্থের মানদন্ডে গণ্য করা হয় বলে শ্রম বা কারিগরী দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়। দক্ষতার সাথে ব্যবহৃত হয় আধুনিক প্রযুক্তি। এ পদ্ধতিতে মালিক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, সংগঠক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ভোক্তা সকলেই পণ্য পরিকল্পনা, বাছাই কিংবা পছন্দের ক্ষেত্রে আপন আপন স্বাধীনতা ভোগ করে। সরকারি নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে সবাই স্বাধীনভাবে স্বীয় কাজ করতে সক্ষম। অধিক মূলধন, বিনিয়োগের সুযোগ, অধিক স্বাধীনতা, অধিক ভোক্তা সন্তুষ্টি, অস্বাভাবিক মুনাফারোধ ইত্যাদি কারণে মুক্তবাজার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অবাধ বাণিজ্য নীতি থাকার কারণে দেশীয় পণ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিত লাভ করে। মুক্তবাজার ব্যবস্থায় এ ধরণের সুবিধার কারণে বিশ্বব্যাপী তা আজ স্বীকৃত।
নেতিবাচক দিক: সমগ্র বিশ্বেই মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রচলন রয়েছে। এটাকে গণতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থাও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো থেকে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের গণতান্ত্রিক রীতি ও আচরণ ভিন্নতর বলে এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এতে বাজার ব্যবস্থা মুক্ত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত হয়। ফলে উন্নত দেশের পণ্য সামগ্রী চাহিদার শীর্ষ স্থান দখল করে। প্রতিযোগিতায় উন্নত দেশের সঙ্গে দেশীয় কোম্পানি টিকতে পারে না। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো হুমকির সম্মুখীন হয় এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সারাবিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। ফলশ্রুতিতে বন্ধ হয়ে যায় দেশীয় কারখানা। বেকার হয়ে পড়ে হাজার হাজার শ্রমিক। দেশীয় ক্রেতারা বিদেশি পণ্যে বেশি আকৃষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাতীয় অর্থনীতি। বাজার দখল করার কৌশল হিসেবে উন্নত দেশগুলো ব্যবহার করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে। ফলে সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক শোষণ। এসব নেতিবাচকতার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনও লক্ষ্য করা গেছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির জনমত মূল্যায়ণ: দেশীয় শিল্প ধ্বংস এবং বেকারত্ব বাড়ার আশঙ্কায় এ ব্যবস্থাকে অনেকেই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। তবে এরূপ আশঙ্কা থাকলেও মুক্তবাজার ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশীয় পণ্যের প্রতিযোগিতার কারণে পণ্যের মান বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যের মান ভালো হলে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের পোশাক এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির কারণেও এ পদ্ধতি অধিকাংশের কাছেই গ্রহণযোগ্য।
উপসংহার: বিশ্ববাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মানসম্মত পণ্যের যোগান ও ভোক্তা সন্তুষ্টি রক্ষায় মুক্তবাজার অর্থনীতির অবদান অনস্বীকার্য। দেশীয় পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যকে উৎকৃষ্টরূপে উপস্থাপনের সুযোগ সৃষ্টিতে মুক্তবাজারের অবদান রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি কল্পে মুক্তবাজার অর্থনীতির কোনো বিকল্প নেই। তাই বিশ্বজুড়ে এ ব্যবস্থা আজ ব্যপকভাবে স্বীকৃত।
No comments