136. ধূমপানের কুফল
ভূমিকা: মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয়গুলোর মধ্যে ধূমপান অন্যতম। তারপরও ধূমপায়ীরা তা আবশ্যক হিসাবে মনে করে। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে একজন ধূমপায়ীর কাছে তার প্রধান খাবারের চেয়েও ধূমপানই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ধূমপায়ীদের এই অভ্যাসটি শরীরের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। এমনকি কখনো কখনো ধূমপান মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।
ধূমপানের ইতিহাস: ধূমপানের ইতিহাস সভ্যতার মতোই প্রাচীন। সেই প্রাচীন কালেই ব্যাবেলনীয় ও মিশরীয়দের মধ্যে ধূমপানের প্রচলন ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে প্রাচীন মিশরীয়রা ‘ক্যানাবিস’ নামক ধূমপানের প্রচলন করেছিল। যা ছিল আদতে আমাদের দেশের হুক্কার একটি রূপ। ১৬ শতকে আমেরিকাতে প্রথম তামাকের চাষ শুরু হয়। ১৮৬৫ সালে ওয়াশিংটন ডিউক নামে আমেরিকার এক ব্যক্তি প্রথম হাতে তৈরি
সিগারেট উদ্ভাবন করে। পরে ১৮৮৩ সালে জেমস বনস্যাক নামে আর এক আমেরিকান সিগারেট তৈরির যন্ত্র উদ্ভাবন করে। যা থেকে দিনে প্রায় এক হাজার সিগারেট তৈরি করা যেত। মোঘল চিত্রকলা অনুযায়ী ভারতীয় উপমহাদেশে ধূমপানের প্রচলন ঘটান মুঘলরা। উপমহাদেশে নবাবি ঘরানার আভিজ্যাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সুগন্ধি তামাক সেবন। পরবর্তী সময়ে হুক্কা ও ছিলিমের সাহায্যেও ধূমপান করা হতো। তামাকের সাহায্যে ধূমপানকে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয় ইউরোপীয়ানরা।
ধূমপানের ধরণ: ধূমপানের রয়েছে নানা ধরন। মানুষ বিভিন্ন উপায়ে ধূমপান করে থাকে। কেউ কেউ আদিকালের হুক্কার সাহায্যে ধূমপান করে যা এখন কেবলমাত্র প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ ৬০/৭০-এর দশকের মতো পাইপের সাহায্যে ধূমপান করে। তবে বর্তমানকালে চুরুট, বিড়ি ও সিগারেটের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ধূমপান করা হয়। বিড়ি ও সিগারেট ধূমপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি মাধ্যম। ধূমপানের প্রধান উপকরণ হলো তামাক। তবে অনেকে ধূমপানের জন্য গাঁজা ও আফিম ব্যবহার করে। তামাক পাতার গুড়োর সাথে আরো কিছু উপাদন মিশিয়ে সেগুলো দিয়ে বিড়ি বা সিগারেট তৈরি করা হয়।
ধূমপান কারণ: ধূমপায়ীরা সবসময়ই ধূমপানের স্বপক্ষে যুক্তি দেখায় যে ধূমপানের ফলে ক্লান্তি কিংবা অবসাদ দূর হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে অনেক জটিল চিন্তাও খুব সহজ হয়ে যায় বলে তারা বিশ্বাস করে। তাদের মতে ধূমপান মাথাকে হালকা করে, ঝড়ঝড়ে করে। ফলে নতুন করে কর্মোদ্যম আসে এবং পূর্ণ মনোযোগ দেয়া যায়। তাই অনেকে ধূমপানের ব্যবহৃত তামাককে বলে ‘ব্রেইন টনিক’। ধূমপায়ীদের মতে ধূমপান আলস্য কাটাতে খুবই কার্যকরী। তাদের কাছে অবকাশ যাপনেও ধূমপান তুলনাহীন। কেউ কেউ আবার মনে করে ধূমপান ‘স্মার্টনেস’ এর পরিচায়ক। আবার কারো কারো মতে ধূমপান তার সামাজিক মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করে। তবে ধূমপায়ীদের কোনো ব্যাখ্যারই বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। মূলত এক প্রকার আসক্তির কারণে তারা ধূমপান করে থাকে।
ধূমপানে বিষপান: ধূমপায়ীরা ধূমপানের স্বপক্ষে যতো যুক্তি দেখাক না কেন, যতভাবেই ধূমপানকে বিচার করুক না কেনো আসলে ধূমপানের কোনো ভালো দিক নেই। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ধূমপান হলো বিষপান। এটা মূলত জেনে শুনে বিষপান করা। ধূমপানের ফলে মানুষ যে ধোঁয়া তার ফুসফুসের মধ্যে টেনে নেয় তাতে থাকে নিকোটিন। এটি কিছু সময়ের জন্য মানুষের মস্তিষ্ককে হয়তো চঞ্চল করে তোলে কিন্তু শরীরের জন্য রেখে যায় দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। ধূমপানের ফলে মানুষ তৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুবরণ করে না। কিন্তু এর নিকোটিন মিশ্রিত ধোঁয়া ধীরে ধীরে ফুসফুসকে গ্রাস করে, অকেজো করে দেয়। ফলে মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। কাশি, হাঁপানি, বক্ষব্যাধির মতো রোগগুলোকে ধূমপান কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সারই নয় কখনো কখনো ধূমপান মুখের ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার, মুত্রথলীর ক্যান্সার, অগ্নাশয়ের ক্যান্সারের মতো জীবননাশী রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য ধূমপান মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় লক্ষাধিক লোক হৃদযন্ত্রের রক্তনালীর সমস্যাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে। যার জন্য দায়ী হলো ধূমপান। ধূমপান শরীরের অন্যান্য রোগকে আরো জটিল করে তোলে। ধূমপায়ী গর্ভবতী নারীদের সন্তানের জন্মের আগেই নানা রকম ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাই ধূমপান শুধু ধোঁয়া সেবনই নয় বরং ধোঁয়ার আড়ালে বিষপান।
ধূমপানের অন্যান্য ক্ষতিকর দিক: ধূমপান যে শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষতির কারণ তা নয় বরং এর আরো অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। ধূমপানের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই ধোঁয়া পরিবেশকে দূষিত করে। ধোঁয়ার দুর্গন্ধ অন্যদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়। ধূমপানের ফলে মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধূমপানের কারণে শুধুমাত্র ধূমপায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং তার আশেপাশে যারা থাকে তাদের স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ে। বিশেষ করে শিশুরা অন্যের ধূমপানের কারণে শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়। ধূমপান বৃদ্ধির কারণে তামাকের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিবর্তে তামাক উৎপাদন করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা একদিন হুমকির মুখে পড়বে।
ধূমপান ও মাদকাসক্তি: ধূমপানের ফলে মানুষ খুব সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। অধূমপায়ীদের মাদকাসক্ত হওয়ার নজির তেমন পাওয়া যায় না। কিন্তু ধূমপায়ীরা একটা সময় মাদকাসক্ত হয়েছে এমন উদাহরণ আমাদের চাপাশেই ভুরি ভুরি রয়েছে। ধূমপানে অভ্যস্তরা অনেক সময় তাদের নেশার একঘেয়েমী অবস্থা দূর করতে অন্য নেশা দ্রব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিড়ি বা সিগারেটের তামাক ফেলে অনেক ধূমপায়ী সেখানে গাঁজা ভরে সেবন করে। একই ভাবে অনেকে আবার হেরোইন কিংবা ব্রাউন সুগার সেবন করে। ধূমপানে নতুনত্ব আনতে আরো চমকপ্রদ কিছু করতে তারা ধূমপানের সাহায্যে বিভিন্ন মাদক দ্রব্য নিতে থাকে। বেশির ভাগ মাদকাসক্তের মাদক নেয়ার অভিজ্ঞতা যাচাই করতে গেলে একটা বিষয়ে মিল থাকবে। আর তা হলো তাদের প্রত্যেকেরই শুরুটা হয়েছিল ধূমপান দিয়ে।
ধূমপান যখন অপরাধ: ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে দেশে দেশে ধূমপান বিরোধী আইন তৈরি হয়েছে। প্রকাশ্যে ধূমপান করা তাই এখন সামাজিক অপরাধ। প্রকাশ্যে ও জনসমাগমে ধূমপান করলে সেটি যেমন অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় তেমনি ধূমপায়ীকে দ ন্ড ও দেয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধূমপায়ীকে জরিমানা হিসেবে দিতে হয়। আমাদের দেশেও প্রকাশ্যে ধূমপান করা দ-নীয় অপরাধ। কিন্তু আইন থাকলেও তার প্রচলন বা প্রয়োগ কোনটাই আমাদের দেশে দেখা যায় না। এখানে তাই সকলে নির্বিঘ্নে প্রকাশ্যে ও জনাকীর্ণ এলাকায় ধূমপান করে। এমনকি যার জরিমানা করার কথা সেই পুলিশেরাও আয়েশি ভঙ্গিতে প্রকাশ্যে ধূমপান করে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলো পুরোপুরিভাবে ধূমপান মুক্ত এলাকা হওয়ার কথা হলেও আমাদের এখানে তার সঠিক চর্চা নেই। তাই সকলেই অপরাধ জেনেও যেখানে সেখানে ধূমপান করে।
ধূমপান প্রতিরোধে করণীয়: ধূমপান প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি ও কার্যকরী পদক্ষেপ হলো ব্যক্তির সদিচ্ছা ও একান্ত প্রচেষ্টা। একজন ব্যক্তি যদি সচেতনভাবে ধূমপানকে এড়িয়ে চলে, আসক্ত হতে না চায় কিংবা ধূমপান ছাড়তে চায় তাহলে সে খুব সহজেই তার মনোবল দিয়ে ধূমপানকে প্রতিরোধ করতে পারে। আর বিশ্বজুড়ে ধূমপান এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে একে প্রতিরোধ করতে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। বরং বড় পরিসরে, সরকারিভাবে এর বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিতে হবে। বাইরের দেশগুলোতে এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। ফলে মানুষ সচেতন হয়েছে। ধূমপান প্রতিরোধ করতে হলে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। সবার আগে তামাক উৎপাদনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ, নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। ধূমপানের বিভিন্ন সামগ্রী ও উপকরণের সকল প্রকার বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রসার বন্ধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। ধূমপানের জন্য উৎপাদিত বিড়ি, সিগারেট বাজারজাতকরণ ও বিক্রির ওপর অধিক কর আরোপ করতে হবে। সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সভা-সেমিনার করতে হবে। গণমাধ্যমগুলোতে ধূমপান বিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। চলচ্চিত্রে প্রিয় তারকার ধূমপানের দৃশ্যে অনেকেই প্রভাবিত হতে পারে। তাই এমন দৃশ্য যথাসম্ভব ব্যবহার না করাই উচিত। করলেও এর ক্ষতি সম্পর্কে বলে দিতে হবে। বড়দের কখনোই শিশুদের সামনে ধূমপান করা উচিত নয়। শিশুদের কাছে এটি যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানগুলোতে ধূমপান বর্জন করা উচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধূমপান বিরোধী বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। দেশব্যাপী ধূমপানের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
উপসংহার: কেউ কেউ বলে মানুষ অভ্যাসের দাস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ কখনোই অভ্যাসের দাস নয়। মানুষ চাইলেই তার যেকোনো অভ্যাসকে পরিত্যাগ করতে পারে। তাই শুধুমাত্র অভ্যাসের দোহাই দিয়ে কেউ ধূমপান ছাড়তে না পারলে বুঝতে হবে সেটি তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা। ধূমপান মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়, মরণব্যাধিতে আক্রান্ত করে। তাই ধূমপায়ীদের উচিত যেকোনো উপায়ে ধূমপান বন্ধ করা। সচেতনভাবে দৃঢ়তার সাথে ধূমপানকে না বললে যে কেউ ধূমপানকে প্রতিরোধ করতে পারবে আর নিজেকে বিষপান থেকে দূরে রাখতে পারবে।
No comments