135.প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য
ভূমিকা: মানুষ সামাজিক জীব। সে একা বসবাস করতে পারে না। সমাজবদ্ধ হয়ে পাড়া- প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে বসবাস করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ঘরের পাশে ঘর, বাড়ির পাশে বাড়ি এবং পরিবারের পাশে অন্য একটি পরিবার অবস্থিতির মাধ্যমে পাড়া বা মহল্লা গড়ে উঠে। এভাবে যারা পাশাপাশি বসবাস করে তারা পরস্পরের প্রতিবেশী। মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনায় তারা এগিয়ে আসে। এ জন্য প্রতিবেশীদের প্রতি আমাদের অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে।
প্রতিবেশী কারা: সাধারণ অর্থে আমাদের আশেপাশে বসবাসকারীদের প্রতিবেশী বলা হয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেন- “আশেপাশে চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত সকলেই প্রতিবেশী।” অর্থাৎ নিজ গৃহের সম্মুখ, পশ্চাৎ, ডান ও বাম দিকের চল্লিশ বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার অন্যভাবে বলা যায়
যে, আত্মীয় সম্পর্কিত না হওয়া সত্ত্বেও যারা আমাদের পাশাপাশি বাড়িতে কাছাকাছি অবস্থান করে তাদের প্রতিবেশী বলে।
প্রতিবেশীর বৈশিষ্ট্য: প্রতিবেশীর মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য থাকে। গ্রামীণ জীবনে মানুষ স্থায়ীভাবে পাশাপাশি বাস করে। বংশানুক্রমে বসবাসের ফলে মানুষের মধ্যে একান্ত আত্মীয় পরিজনের সম্পর্ক গড়ে উঠে। অনাত্মীয় লোকজনের সঙ্গেও পাশাপাশি প্রতিবেশী হিসেবে বাস করার ফলে আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু শহরাঞ্চলের প্রতিবেশী দুই ধরণের হয়। শহরের বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে অনেকে অস্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাদের অস্থায়ী প্রতিবেশী হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। মানুষের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে হলে অন্যের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। আর প্রাথমিকভাবে এই সাহায্য সহযোগিতা মানুষ প্রতিবেশীর নিকট থেকেই পেয়ে থাকে।
প্রতিবেশীর ধরন: প্রতিবেশী হিসেবে যারা পাশাপাশি অবস্থান করে তাদের সকলের ধরণ এক রকম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রতিবেশীদের মধ্যে নানা ধরণের লোক থাকে। প্রতিবেশী হিসেবে যেমন ধনী লোক আছে তেমনি গরীব লোকও আছে। আবার এক দিকে যেমন শিক্ষিত লোক আছে তেমনি অশিক্ষিত লোকেরও অভাব নেই। কেউ বিশাল বাড়িতে বাস করে, কেউ সামান্য কুঁড়ের ঘরে দিন কাটায়। এভাবে বিচিত্র মানুষ নিয়েই প্রতিবেশীর অবস্থান। পেশাগত দিক দিয়েও প্রতিবেশীদের মধ্যে বৈচিত্র্য দেখা যায়। তাদের মধ্যে নানা ধরণের বৈচিত্র্য থাকলেও এক দিকে তাদের মিল রয়েছে তা হলো তারা পরস্পরের প্রতিবেশী। বাইরের সম্পর্ক যাই হোক না কেনো তাদের প্রতিবেশী সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারা প্রতিনিয়ত দেখা হলে সৌজন্য প্রকাশ করে, খোঁজ-খবর নেয় এবং আপদে-বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য: প্রতিটি মানুষই তার প্রতিবেশীর প্রতি অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। কারণ সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ তার প্রতিবেশীর সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমেই জীবনযাপন করে। মানুষ সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই জীবন যাপনের জন্য প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। আর প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে হয়।
পারস্পরিক সহযোগিতা: পারস্পরিক সহযোগিতার উপর ভিত্তি করেই মূলত প্রতিবেশী সম্পর্ক টিকে থাকে। জীবনের নানা প্রতিকূলতায় প্রথম প্রতিবেশী খবর পায় এবং সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। এভাবে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতায় প্রতিবেশীদের মধ্যে এক ধরণের মধুর সম্পর্ক তৈরি করে। তাই জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে প্রতিবশীর নিকট থেকে যেমন সহযেগিতা দরকার তেমনি তাদের আপদ-বিপদেও এগিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
প্রতিবেশীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা: পৃথিবীতে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। এতে মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পায়। তাই জীবনকে সার্থকভাবে গড়ে তুলতে হলে সমাজের প্রতিটি মানুষকে নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিবেশীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। তাদের আপদে-বিপদে, সুখে-দুঃখে, অভাব-অনটনে খোঁজখবর নিতে হবে। যারা বিত্তবান তাদের কাজ হলো গরীব প্রতিবেশীদের অভাব-অনটন দূর করা। তাদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের বিধান করা। এভাবে আমরা সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিবেশীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করতে পারি।
প্রতিবেশীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে নিরাপত্তার প্রয়োজন। নিরাপত্তার অভাবে মানুষের জীবন সবসময় ভয়-ভীতির মধ্যে কাটে। এর ফলে শুধু সমাজে বসবাসরত প্রতিবেশীই নয়, জাতীয় জীবনেও নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। তাই এক প্রতিবেশীর অন্য প্রতিবেশীর জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। প্রতিবেশী যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিতভাবে বসবাস করতে পারে সেদিকে আমাদের সবারই নজর দিতে হবে। তাহলে প্রতিবেশীদের আচার ব্যবহার জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে।
সদ্ব্যবহার ও সুসম্পর্ক: প্রতিবেশীরা আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। প্রতিটি দিনই তাদের সাথে কোনো না কোনোভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয়। আর প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হলে সদ্ব্যবহার করা উচিত। সদ্ব্যবহারে প্রতিবেশীরা শান্তি পায়। আবার প্রতিবেশীদের সাথে কখনো ঝগড়া-ফ্যাসাদ করা উচিত নয়। তাদের সাথে সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত।
সহানুভূতিশীলতা: আমাদের সমাজে এমনক কিছু লোক আছে যারা প্রতিবেশীদের নিয়ে ভাবার সময় পায় না। আবার কিছু লোক আছে সময় পেলেও প্রতিবেশী সম্পর্কে উদাসীন থাকে। তারা সব সময় নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। এ শ্রেণির লোকেরা পারলে প্রতিবেশীদের ঠকানোর চেষ্টা করে। যদিও এরা সমাজের উচ্চপদে অসীন থাকে এবং লোক দেখানো সম্মান পায় কিন্তু প্রতিবেশীদের কোনো প্রকৃত সম্মান পায় না। তাই প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়।
মহৎ ব্যক্তিগণের সহানুভূতিশীলতা: পৃথিবীর সকল ধর্মের মহৎ ব্যক্তিগণ প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (স.), গৌতম বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ ও যিশু খ্রিস্ট এরা সবাই প্রতিবেশীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। প্রতিবেশী সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন- “আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার নিজ প্রতিবেশীর নিকট উত্তম।” মহৎ ব্যক্তিরা শুধু প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতিশীলই ছিলেন না বরং প্রতিবেশীদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এভাবে তারা প্রেম, ভালোবাসা, ধৈর্য ও আদর্শ দিয়ে প্রতিবেশীদের মন জয় করেছিলেন।
প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের সুফল: প্রতিবেশীদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করলে তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং তা জীবনযাপনের জন্য বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠে। প্রতিবেশী ভালো হলে আপদে-বিপদে সাহায্য এবং নিরাপদে নিশ্চিতে বসবাস করা যায়। আর প্রতিবেশী খারাপ হলে অশান্তির শেষ থাকে না। কিন্তু প্রতিবেশীদের সাথে সু-সম্পর্ক এক দিক থেকে হয় না। পারপস্পরিক আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন।
উপসংহার: প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে আত্মীয়ের চেয়েও গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সামাজিক জীবনে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা মানুষ প্রতিবেশীর নিকট থেকে পেয়ে থাকে। সে জন্য আমাদের ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-মন্দ সকল রকম প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাহলেই পরস্পরের মঙ্গল সাধিত হবে। এ প্রসঙ্গে কামিনী রায় তাঁর পরার্থে কবিতায় বলেন- “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
No comments