03. তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষ
হযরত মুহাম্মদ (স.) / আদর্শ মহাপুরুষ
ভূমিকা
সমাজ জীবনে যখন বিশৃঙ্খলা, কুসংস্কার ও বিচ্ছিন্নতার অশুভ প্রেতনৃত্যে চতুর্দিক আচ্ছন্ন,পরিবেশ যেখানে বিষাক্ত ও কলুষিত, জীবনের সর্বক্ষেত্রেই যখন অবক্ষয়ের লক্ষণ দৃশ্যমান,অজ্ঞানতার ঘোর অন্ধকারে মানুষ যখন দিশেহারা, তখনই পথভ্রষ্ট মানুষকে হতাশা থেকে,রুদ্ধশ্বাস অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে ইহলোকে আবির্ভাব ঘটে জ্যোতির্ময় এক মহাপুরুষের। সত্যের জ্যোতিতে বিশ্বলোক হয় উদ্ভাসিত। তাঁদেরই আদর্শ ও সত্য-দৃষ্টি
বিভ্রান্ত মানুষকে মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে। করে নিত্য-নতুন কল্যাণবোধে উদ্দীপ্ত। এমনি করেই যুগে যুগে কত মহাপুরুষের পুণ্য আবির্ভাবে অসহায়, পঙ্গু দুর্বল মানুষ খুঁজে পেয়েছে অন্ধকারে আলো, হতাশায় আশ্বাস, দুঃখে সান্ত্বনা। মধ্যযুগের আরব জাতির জীবনও ছিল এরকমই হতাশা, কুপ্রথা, মূর্তিপূজা, কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন। জড়তাগ্রস্ত, হতাশাচ্ছন্ন ও অন্ধ তামসিকতামগ্ন আরবজাতিকে মুক্তি দিতে এলেন আল্লাহ প্রেরিত মহাপুরুষ, মানব মুক্তির দূত হযরত মুহম্মদ (স.)। পৃথিবী হল আলোকময়।
বিভ্রান্ত মানুষকে মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে। করে নিত্য-নতুন কল্যাণবোধে উদ্দীপ্ত। এমনি করেই যুগে যুগে কত মহাপুরুষের পুণ্য আবির্ভাবে অসহায়, পঙ্গু দুর্বল মানুষ খুঁজে পেয়েছে অন্ধকারে আলো, হতাশায় আশ্বাস, দুঃখে সান্ত্বনা। মধ্যযুগের আরব জাতির জীবনও ছিল এরকমই হতাশা, কুপ্রথা, মূর্তিপূজা, কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন। জড়তাগ্রস্ত, হতাশাচ্ছন্ন ও অন্ধ তামসিকতামগ্ন আরবজাতিকে মুক্তি দিতে এলেন আল্লাহ প্রেরিত মহাপুরুষ, মানব মুক্তির দূত হযরত মুহম্মদ (স.)। পৃথিবী হল আলোকময়।
জন্ম ও কিশোর জীবন
সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর হাবীব, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (স.) আরবের এক ঐতিহ্যবাহী কুরাইশ বংশে ২৪ আগস্ট ১২ রবিউল আউয়াল ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম বিবি আমেনা। হযরত মুহম্মদ (স.) এর জন্মের পূর্বেই তার বাবা আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। মুহম্মদ (স.)-এর মাত্র ছয় বছর বয়সে কালজয়ী এই মহাপুরুষ তাঁর মাতা হযরত আমেনাকে হারান। তারপর পিতামহ আব্দুল মোত্তালিবের মধুর স্নেহের ছায়ায় বেড়ে উঠতে লাগলেন। দাদার অকৃত্রিম ভালোবাসার পরশে হযরত মুহাম্মদ পিতামাতার অভাব অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, দাদা মোত্তালিব মাত্র ৮ বছরের নাতি হযরত মুহম্মদ (স.) কে ইহলোকে রেখে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। পরবর্তীতে পিতৃব্য আবু তালিব তাঁর লালন-পালনের দায়িত্ব নেন।
কৈশরের সততা, সহজ আর সরল স্বভাব ও অপরিসীম কর্তব্যপরায়ণতা, অকৃত্রিম গুণাবলির জন্যে তৎকালীন আরব সন্তানেরা আল-আমীন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেন।
বৈবাহিক জীবন
মক্কানগরীর অর্থ ও প্রাচুর্যশালী স্বামীহারা এক বিধবানারী বিবি খাদিজা (রা.) সুদর্শন যুবক নবীজীর সুখ্যাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে নিজ ব্যবসায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। বিবি খাদিজা (রা.) তাঁর সততায় অভিভূত হয়ে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। ২৫ বছর বয়সে হযরত মুহম্মদ (স.) ৪০ বছর বয়স্ক বিবি খাদিজার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
নবুয়ত প্রাপ্তি
হেরা পর্বতের গুহায় হযরত মুহম্মদ (স.) আল্লাহর দরবারে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন,এই সময়েই আল্লাহর আদেশে জিবরাইল ফিরেশতা তাঁকে নবুয়তের খোশ খবর দিয়ে অহি অর্পণ (নাজেল) করেন। যা তিনি পরবর্তীতে আল্লাহর বাণী হিসেবে কোরানের আকারে মানবসমাজে প্রচার করেন এবং আল-কোরান তাঁর উপরে নাযিল হওয়ার পর থেকে তিনি নবী বা রসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ কররেন।
ধর্ম প্রচার
হযরত মুহম্মদ (স.) অহি প্রাপ্তির পরপরই আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রা.)-ই হলেন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত প্রথম নারী। তারপর ইসলাম গ্রহণ করেন কিশোর হযরত আলী (রা.) এবং যায়েদ-বিন-হারেস। ক্রমে নবীর আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, বিধর্মী কোরাইশগণ ক্ষীপ্ত হয়ে নবীজী ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে নানারকম অত্যাচার ও উৎপীড়ন শুরু করে দেয়। সকল বাধা পেরিয়ে ইসলামের জয়যাত্রাকে অক্ষুণ্ন রেখে সত্যপথ থেকে একবিন্দুও সরে দাঁড়ান নি হযরত মুহম্মদ (স)। প্রতিপক্ষ বিধর্মীরা ইসলামের উত্থানে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। একদিন তারা একত্রিত হয়ে পরামর্শ করে হযরত মুহম্মদ (স.) কে হত্যা করে ইসলাম ধর্ম প্রচার স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু বিধর্মী কোরাইশ নেতাদের মনষ্কামনা পূরণ হয়নি।
মদিনার পথে মুহাম্মদ
কোরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ মহানবী আল্লাহর আদেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় জন্মভূমি মক্কানগরী ত্যাগ করে মদিনায় আশ্রয় খুঁজে নেন। মহানবীর এই মদিনা গমনকেই‘হিযরত’ বলা হয়। মদিনার পূর্বনাম ছিল ইয়াসরিব। হযরত মুহম্মদ (স)-এর মদিনা আগমনে তাঁর সম্মানার্থে এর নাম রাখা হয় ‘মদিনাতুন্নবী’ বা নবীর শহর- যাকে সংক্ষেপে আমরা জানি মদিনা হিসেবে। যেসব বিশ্বাসী মুসলমান জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় গিয়েছিলেন তাঁদের ‘মহাজেরীন’ এবং যে-সব মদিনাবাসী তাঁদের আশ্রয় সহযোগিতা দিয়েছিলেন তাঁদের ‘আনসার’ বলা হয়।
মদিনা সনদ
হযরত মুহম্মদ (স.) মুসলমান ও বিধর্মী ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির জন্য এবং মদিনা রক্ষার জন্য সকলের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্য গড়ে তোলার জন্যে যে সনদ প্রস্তুত করেন তা ‘মদিনা সনদ’ নামে খ্যাত। এই সনদকে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসুলুল্লাহ (স) শুধু ধর্ম প্রচারকই ছিলেন না, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদও ছিলেন।
যুদ্ধ জয়
মদিনায় ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা এবং হযরত মুহম্মদ (স.) এর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে মক্কার কোরাইশগণ শঙ্কিত ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠন ও মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারে বিধর্মীরা ইসলাম ধর্ম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধ বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিধর্মীরা প্রায় সবগুলো যুদ্ধেই পরাজয়বরণ করে। অবশেষে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। হযরত মুহম্মদ (স.)-এর প্রচারিত ইসলাম ধর্মে কোনো জাতিভেদ, বর্ণভেদ, উচু-নিচু, ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ নেই। এজন্যেই মহান আল্লাহপাকের এই ধর্ম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠধর্ম হিসেবে শেষ অবধি টিকে আছে এবং আজীবন টিকে থাকবে।
মুহাম্মদের জীবন দর্শন
চরিত্র
হযরত মুহম্মদ (স.) বিশ্বমানবের আদর্শ পুরুষ। তিনি সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। তাঁর অবয়ব থেকে প্রতিভা ও দৃঢ়সংকল্পের যে জ্যোতি বিচ্ছুরিত হত তা সবাইকে মুগ্ধ করত। তাঁর বাক্য এমন বিনয়ী ও মনোহর ছিল যে, শত্রুরা পর্যন্ত তাঁর আকর্ষণীয় শক্তি অনুভব করে বলতো, ‘মুহম্মদের বাক্যে ইন্দ্রজাল আছে।’ তিনি যেমন আধ্যাত্বিক বিষয়ে তেমনি বাহ্য-বেশ-বিন্যাসের ও আদর্শস্থানীয় ছিলেন। হযরত মুহম্মদ (স.) এমন শিষ্টাচারী ছিলেন যে, কারো সঙ্গে দেখা হলে তিনিই আগে সালাম দিতেন।
স্নেহপরায়ণতা
হযরত মুহম্মদ (স.) শিশু কিশোরদের অত্যন্ত আদর করতেন, তাদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলতেন। একবার নামাজের সিজদা দিবার সময় তাঁর দৌহিত্র শিশু হুসাইন তাঁর ঘাড়ে চড়ে বসেছিলেন। হুসাইনের নেমে যাওয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করে তবেই সিজদা থেকে মাথা উত্তোলন করেন। তিনি অনেক সময় নিজে উট সেজে হাসান-হুসাইনকে সেই উটে চড়াতে ভালোবাসতেন।
সম্মানবোধ
আত্মসম্মানবোধ অতিপ্রবল ছিল বলে ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি ঘৃণা করতেন। একদা এক ভিক্ষুক তাঁর কাছে উপস্থিত হলে, তিনি তাকে একখানা কুঠার দান করে বলেছিলেন, এটা নিয়ে কাঠ কেটে তাই বিক্রি করে জীবন ধারণ করবে। এছাড়া তিনি কারো দান গ্রহণ করতেন না। পারস্য দেশের এক কৃষক সন্তান সালমান নবীজীর এই মহান গুণ দেখে তাঁকে চিনতে পেরে তাঁর কাছে ইসলামের দীক্ষা নিয়ে ছিলেন।
বৈশিষ্ট্য
সকলে মোরা সকলের তরে প্রত্যেকে মোরা পরের তরে-এই নীতিবাক্য তিনি কেবল মুখেই প্রচার করেন নি, কার্যেও তার অগণিত প্রমাণ দিয়ে গেছেন। তিনি দাস-দাসীর কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করতেন, তাদেরও তেমনি সেবা দিতেন। কখনো কখনো দাসকে উটে চড়িয়ে নিজে পদব্রজে চলতেন।
চারিত্রিক দৃঢ়তা
হযরত মুহম্মদ (স.) ছিলেন সংকল্পে অটল, অবিচল, কোনো প্রকার লোভ, অত্যাচার,ক্ষমতা-মোহ কিছুই তাঁকে সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি এবং বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে নিজের জীবনকে তিনি সুসংবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বিপদে অসীম ধৈর্য,বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেন এসব মহৎ গুণের কারণেই তিনি পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত।
ক্ষমাশীল
ক্ষমাশীলতায় মুহম্মদ ইহলোকে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। নিজের প্রাণঘাতী শত্রুকে বারবার হাতের মুঠোয় পেয়েও তিনি তাদের ক্ষমার কোমল স্পর্শ থেকে বঞ্চিত করেন নি। মক্কা বিজয় কালে যখন শত্রুরা প্রাণের আশঙ্কায় বিচলিত, মুহম্মদ তাঁর চিরাচরিত স্বভাবধর্ম অনুযায়ী তাদের সবাইকে ক্ষমা করে বিশ্বের দরবারে ক্ষমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সংস্কারক
মুহম্মদের অন্য এক বড় পরিচয় হল তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সার্থক এবং বিপ্লবী সংস্কারক। তিনিই তার সমাজের অচলায়তন জীর্ণ প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলেন। নারী মর্যাদাকে বিবেচনা করে তিনি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দান করেন। নারীর শাশ্বত মাতৃত্বের গৌরব তিনিই প্রচার করেন। ঘোষণা করেন,জননীর পদতলে সন্তানের মুক্তিপথরেখা।
মহানবীর ওফাত
মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স.) ৬৩ বছর বয়সে একদশ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল (৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন) সোমবার দ্বিপ্রহরে নামাজরত অবস্থায় ইহজগতের মানুষকে শোকসাগরে ভাসিয়ে জান্নাতগমন করেন।
No comments