32.কৃষিকাজে বিজ্ঞান

ভূমিকা: বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ধারাবাহিকতায় কৃষির বিবর্তন মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এনেছে।কৃষি নির্ভরশীলতা, কৃষি উৎপাদন আজ এক অনন্য মাত্রায় স্থান পেয়েছে। বিজ্ঞানের জয়জয়কারের মাঝে সনাতনীকৃষি ব্যবস্থা আবির্ভূত হয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থায়। এই বিবর্তনের সুফল যেমন কৃষক ভোগ করছে তেমনি সাধারণমানুষ। যা একশ বছর আগের মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা কৃষিতে আধুনিক বিজ্ঞানেরছোঁয়া ফসলের সংরক্ষণ ব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন করেছে। যা আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম বিস্ময়।
কৃষির সনাতন পদ্ধতি: কৃষি সরাসরি মানুষের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত বিষয় আদিম সমাজ থেকে শুরু করেবর্তমান সময় পর্যন্ত কৃষির গুরুত্ব অপরিবর্তিত রয়েছে টিকে থাকার প্রয়োজনে প্রয়োজন যেমন উদ্ভাবন করতেঅনুপ্রাণিত করে তেমনি আদিম সমাজের মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কৃষির প্রয়োজনীয়
যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে যারমাধ্যমে তারা চাষাবাদ করত প্রাথমিক অবস্থায় গরুঘোড়ামহিষ প্রভৃতি জন্তুর সাহায্যে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষকরা হতো আবহাওয়া নির্ভরশীল কৃষি ব্যবস্থার কারণে প্রচখরায়  অতিবৃষ্টিতে ফসলহানির কারণে দুর্ভিক্ষদেখা দিত একই ফসল একই জমিতে ধারাবাহিক পাদনের ফলে জমির উর্বরতা হ্রাস পেত ভাল  উন্নতবীজের গুণগত মান নির্ণয় করা যেত নাযে কারণে ফসলের পাদন ভাল হত না বৃষ্টির উপর এককনির্ভরশীলতার কারণে কৃষকের ফসল পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ব্যবস্থারকারণে মাঠের ফসলের উপর বেঁচে থাকার নির্ভরতা ছিল যার মাধ্যমে কৃষক  কৃষির প্রাচীন পদ্ধতিতে হতাশারপ্রতিচ্ছবি সহজেই অনুমেয়
বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা: মানুষের খাদ্যের যোগান হয় কৃষি থেকে আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে কৃষিকাজেরসনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবংউনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে কৃষির আধুনিকায়নের সূচনা ঘটে তখন থেকে কৃষকেরাআধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির সাথে পরিচিত হয় লাঙ্গল-জোঁয়ালগরু-মহিষ এর পরিবর্তে কৃষকের হাতে আসে কলেরলাঙ্গলট্রাক্টর  পাওয়ার টিলার সনাতনী সেচ পদ্ধতি  প্রাকৃতিক বৃষ্টি নির্ভরতার বিপরীতে কৃষকের হাতেএসেছে গভীর  অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থাবিদ্যু চালিত পাম্প  কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোরমত যন্ত্র উন্নতমানের বীজ পাদন  আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এর মান নিয়ন্ত্রণসহ সঠিক বীজ নির্বাচনবিজ্ঞানের অন্যতম সাফল্য যা এখন কৃষকের হাতের নাগালে রাসায়নিক সার আবিষ্কার ফসলের অধিক ফলনেরক্ষেত্রে এনেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন
উন্নত বিশ্বে কৃষিকাজউন্নত বিশ্বে কৃষিকাজ একটি সম্মানজনক পেশা কৃষির সাথে সম্পৃক্তরা সমাজের বিশেষমর্যাদায় অধিষ্ঠিত কারণ কৃষির মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই তাদেরকে উন্নত জীবনযাত্রা দিয়েছেকমিয়েছেপরনির্ভরশীলতা মাটির উর্বর ক্ষমতা নির্ণয় থেকে শুরু করে ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে প্রযুক্তিরব্যবহার তাদের কৃষি ব্যবস্থাকে অনন্য মাত্রায় স্থান করে দিয়েছে বর্তমানে তাদের দেশের কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবেপ্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় একদিকে শ্রমশক্তি কম লাগছেঅন্যদিকে সময়ও কম অপচয় হচ্ছে প্রযুক্তির কল্যাণেশীতপ্রধান দেশে তাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে শাক-সবজি  ফলমূল পাদন হচ্ছে মরুভূমিতে বালি সরিয়ে মাটি ফেলেসেচের মাধ্যমে ফসল পাদন করা হচ্ছে কোনো কোনো উন্নত দেশে একটি মেশিনে দৈনিক ১০০ একর জমি চাষহচ্ছে জাপানের জমির উর্বরতা বাংলাদেশের জমির চেয়ে ৩গুণ কম হওয়া স্বত্তেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহারেরফলে তারা বাংলাদেশের চেয়ে  গুণ বেশি ফসল পায়
অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি: বিজ্ঞান নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার অন্যতম চমক হলো অত্যাধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যামানুষের সময়  শ্রম বাঁচিয়েছে বহুগুণে এরমধ্যে কয়েকটি হলো-
মোয়ার (শস্য ছেদনকারী যন্ত্র), রূপার (ফসল কাটার যন্ত্র), বাইন্ডার (ফসল বাধার যন্ত্র), থ্রেশিং মেশিন (মাড়াইযন্ত্র), ম্যানিউর স্প্রেডার (সার বিস্তারণ যন্ত্র), ট্রাক্টর (চাষাবাদ করার যন্ত্র)
এছাড়াও রয়েছে মাটি পরীক্ষা করামাটির সাথে মিলিয়ে বীজ পাদন করার আধুনিক সব যন্ত্রপাতি আর কৃষিযন্ত্রের সর্বশেষ ব্যবহার হলো আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময় কম্পিউটার এর মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেপ্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তাই কৃষি এখন কম্পিউটারাইজড বিজ্ঞানের অংশ
বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থা: বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ এদেশের ভূমি  জলবায়ু অন্য যেকোনো দেশেরতুলনায় কৃষির জন্য অনেক বেশি উপযোগী এখানে সব রকমের ফসল আবাদ করা যায় কিন্তু উন্নত দেশসমূহযেখানে প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও ফসল পাদনে সফলতা অর্জন করেছেবাংলাদেশের কৃষকসেখানে চেয়ে আছে বৃষ্টির পানে বলদ-জোয়াল নিয়ে আমাদের দেশে কৃষিকাজ পেশা হিসেবে সবচেয়ে নিচুমানেরপেশা মনে করা হয় যেজন্য শিক্ষিত মহল  পেশায় সরাসরি সংযুক্ত হয় না আর অশিক্ষিত কৃষক যেমন জানে নাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ তেমনি জানে না আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণেকমে আসছে কৃষিজমি এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পেশাদার কৃষক যদিও বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষিনিয়ে গবেষণা হচ্ছে তথাপি শতকরা ৮০ ভাগ কৃষক এখনও সনাতনী পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে মূলধনশিক্ষা সচেতনতার অভাবে প্রচুর শ্রম দিয়েও বাংলার কৃষক কাঙ্ক্ষিত ফসল পাচ্ছে না আর এর একমাত্র কারণ বৈজ্ঞানিকপদ্ধতিতে কৃষিকাজে পিছিয়ে থাকা
বাংলাদেশে বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাসীমিত সম্পদের মাধ্যমে অসীম চাহিদা মেটাতে হলেআধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার বিকল্প নেই আমাদের দেশের এই স্বল্প আবাদী জমিতে প্রায় ১৬ কোটিজনগণের খাবার পাদন সনাতনী পদ্ধতিতে অসম্ভব তাই কাঠের লাঙ্গলকে বিদায় জানাতে হবে কৃষকের হাতেতুলে দিতে হবে বিজ্ঞানের হাতিয়ার ট্রাক্টর  অন্যান্য যন্ত্রপাতি
বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষি গবেষণায় বাংলাদেশ: গবেষণার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ দরিদ্র দেশ হওয়া স্বত্ত্বেও বাংলাদেশেকৃষি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে যেমন- BRRI (Bangladesh Rice Research Institute), ধানের জাত নিয়েগবেষণা করে থাকেBINA (Bangladesh Institute of Nuclear Agriculture)  সকল প্রতিষ্ঠান কৃষিরউন্নয়নে ব্যাপকতর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে  গবেষণা কেন্দ্র আছে কয়েকটি এছাড়াও ব্যক্তিমালিকানাধীনপ্রতিষ্ঠানেও কৃষি বিষয়ক গবেষণা হচ্ছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের পাটের জীবন রহস্য উদ্ভাবনমহিষের জীবনরহস্য উদ্ভাবন বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক
কৃষিতে বিজ্ঞানের ক্ষতিকর প্রভাব: বিজ্ঞানের চরম কর্ষতার পাশাপাশি কৃষিতে কিছু ক্ষতিসাধন হচ্ছেবিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিকাজের মাধ্যমে তাই বলে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই বরংসর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমে ক্ষতিকর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে হবে যেমন:অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার কৃষিজমির স্বাভাবিক উর্বরতা কমাচ্ছে যা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক সার  কীটনাশক ব্যবহারের কারণেপরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এবং পানিতে মিশে গিয়ে  সম্পদেরও ক্ষতি করছে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে কৃত্রিম ঘরেতাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সবুজ শাক-সবজি চাষাবাদ গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কারণে বায়ুম-লের তাপমাত্রা বাড়িয়েদিচ্ছে এসব সমস্যা একসময় বড় আকার ধারণ করে রূপ নিচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগেযাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রান্তিককৃষকরা তাই ইতিবাচক ব্যবহারই পারে অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতি থেকে বাঁচাতে
উপসংহার: মানব কল্যাণে বিজ্ঞানের ব্যবহারের অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কৃষিবিজ্ঞান মানুষের উদ্ভাবনীশক্তি কৃষিকে আজ এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে এসেছে সনাতনী পদ্ধতি থেকে কম্পিউটার এই বিবর্তনের সবচেয়েপুরনো সাক্ষী হিসেবে কৃষি তার আদিম নামেই পরিচিত স্বল্প জায়গায় অধিক ফসলের প্রয়োজনীয়তা তাই কৃষিকেনিয়ে গেছে বিজ্ঞানীর ল্যাবরোটরিতে যেখানে উন্নয়ন হয়েছে কৃষি  কৃষকের পরিবর্তন হয়েছে পদ্ধতির উঠেএসেছে আধুনিক সব ব্যবস্থাপত্র যার মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন যে পরিবর্তনের সুফলপাচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ

No comments

Powered by Blogger.