31. কিশোর অপরাধ


ভূমিকাঃ আধুনিক বিশ্বের অসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের নেতিবাচক ফল হলো কিশোর অপরাধ। পরিবার কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তনশহর ও বস্তির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এবং সমাজজীবনে বিরাজমান নৈরাজ্য ও হতাশা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান কারণ। অপসংস্কৃতির বাঁধ ভাঙা জোয়ারও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- তের চৌদ্দ বছরের মতো এমন বালাই আর নেই। এ বয়সের ছেলেমেয়েদের সামনে থাকে অদম্য আশা আর জীবন জগৎ সম্পর্কে থাকে অতিকৌতূহল। অনেক সময় প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আশাভঙ্গের বেদনায় হতাশার হাত ধরে নৈরাশ্যের অন্ধকারে পতিত হয় তাদের জীবন। এতে কিশোর বয়সীরা ধীরে ধীরে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধ দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
কিশোর অপরাধ কিঃ কিশোর বয়সীদের দ্বারা সংঘটিত সমাজে বিদ্যমান মূল্যবোধ ও নিয়মনীতি বিরোধী কাজই কিশোর অপরাধ। তবে সামাজিক মূল্যবোধ রাষ্ট্রশহরগ্রাম বা এলাকাভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এক সমাজে যে কাজ বা আচরণ মূল্যবোধ ও নীতি বিরোধী অন্য সমাজে তা নাও হতে পারে। অপরাধ বিজ্ঞানী বিসলার বলেছেন- কিশোর অপরাধ হলো প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুনের উপর অপ্রাপ্ত
বয়স্ক কিশোরদের অবৈধ হস্তক্ষেপ।’ আবার অপরাধ বিজ্ঞানী বার্ট বলেছেন-কোনো শিশুকে তখনই অপরাধী মনে করতে হবে যখন তার অসামাজিক কাজ বা অপরাধ প্রবণতার জন্য আইনগত ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে। মূলত বিশেষ ধরণের অস্বাভাবিক ও সমাজ বিরোধী কাজ যা কিশোর-কিশোরীরা সংঘটিত করে তাকে কিশোর অপরাধ বলে।

কিশোর অপরাধের বৈশিষ্ট্যঃ কিশোর-কিশোরী ও অপ্রাপ্তবয়স্করা চিন্তাভাবনা না করে আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ দ্বারা অতিসহজে ও স্বল্প সময়ে প্রভাবিত হয়। তারা উদ্দেশ্যহীনভাবেকৌতূহলবশত বা নিজেকে জনগণের সামনে প্রকাশ করার জন্য অপরাধ করে থাকে। কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়। যেমন-

-
কিশোর বা অপ্রাপ্ত বয়স্করাই এ ধরণের অপরাধ করে

প্রতিকূল পরিবেশে সামাজিক সংগঠন ও কার্যাবলীর সাথে তাল মেলাতে না পেরে তারা সমাজ বিরোধী কাজে অংশ নেয়।

এটি সামাজিক মূল্যবোধ ও নিয়ম-শৃঙ্খলার পরিপন্থী কাজ করে।

কিশোররা নিজের চিন্তা ও কাজকে সঠিক বলে প্রাধান্য দেয়।

অতি উৎসাহ ও কৌতূহলের বশে উদ্দেশ্যহীনভাবে অসামাজিক কাজ তথা অপরাধ করে।

যথাসময়ে কিশোররা সংশোধন না হলে কালক্রমে অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে।

কিশোর অপরাধের ধরণ ও প্রকৃতিঃ সামাজিক সমস্যা হিসেবে এবং অপরাধ জগতে কিশোর অপরাধ ক্রমবর্ধমানশীল। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি। বাংলাদেশের সার্বিক দিক বিবেচনায় কিশোর অপরাধ বা অপরাধীকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় যেমন-১। শহর এলাকার কিশোর অপরাধী ২। গ্রাম এলাকার কিশোর অপরাধী ৩। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর অপরাধী ৪। উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোর অপরাধী।আর এ সকল কিশোর অপরাধীদের মধ্যে প্রধানত যেসব অপরাধ লক্ষ্য করা যায় তা হলো- জুয়া খেলানেশা করাখেলার মাঠ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিবাসট্রেন ও সিনেমা হলে বিনা টিকিটে যাওয়া,পরীক্ষায় নকল করাএসিড নিক্ষেপরাস্তাঘাটে ছিনতাইমারপিটঅন্যের বাগানের বা ক্ষেত্রের ফল ও ফসল চুরি করা ইত্যাদি।
কিশোর অপরাধী কারাঃ কিশোর অপরাধী হলো সেই সকল কিশোর কিশোরী যারা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুকরণ করতে না শিখে সমাজ বিরোধী চিন্তা ও কাজে অংশ নেয়। বয়সের দিক থেকে সাধারণ ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোর কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধই কিশোর অপরাধ। তবে বিভিন্ন দেশে বয়সের তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো দেশে ১৩ থেকে ২২ বছর আবার কোনো দেশে ১৬ থেকে ২১ বছর বয়সী কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপানে ১৪ বছরেরফিলিপাইনে ৯ বছরের এবং ভারতশ্রীলংকা ও মিয়ানমারে ৭ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। বাংলাদেশে ১৮ বছরের কেউ অপরাধ করলে কিশোর অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবে। কিশোর অপরাধীদের আচরণ ও কাজকে কম অপরাধমূলক ভাবা হয় ও অপরাধের কারণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কৃত অপরাধের জন্য শাস্তিপ্রদান না করে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হয়।
কিশোর অপরাধের কারণঃ শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী সমাজের মতো বর্তমানে স্বল্পোন্নত সমাজেও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বাড়লেও সাম্প্রতিককালে এ প্রবণতা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজে বিদ্যমানহতাশানৈরাজ্য আর দারিদ্র্য কিশোর অপরাধ সৃষ্টির প্রধান কারণ। শহরের দূষিত পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন ও অশিক্ষাক্ষুধা,দারিদ্র্য কিশোরদের চুরিছিনতাইপকেটমারের মতো অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করে। মূলত সামগ্রিকভাবে কিশোর অপরাধের প্রধান কারণগুলো হলো- ভগ্ন পরিবার ও পিতামাতার দাম্পত্য কলহ যেখানে আবেগভালোবাসা ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে চরম দারিদ্র্য ও পিতামাতার অবহেলা শিশুশ্রম ও জোরপূর্বক শিশুকে কাজে বাধ্য করা খারাপ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করাপারিবারিক অস্থিতিশীলতা ও অসম্প্রীতিপিতা বা মাতার পুনর্বিবাহমা কর্মজীবী হওয়ায় পর্যাপ্ত শিশুযত্নের অভাবঅতিরিক্ত শাসনরক্ষণশীলতা ও বাবা-মার পরস্পরবিরোধী মানসিকতাস্বার্থপর ও ফন্দিবাজ রাজনীতিবিদ কর্তৃক কিশোরদের পিকেটিং-এ ব্যবহারসামাজিকধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব এবংঅপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি।
সমাজ জীবনে কিশোর অপরাধের নেতিবাচক প্রভাবঃ আজকের কিশোর কিশোরীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই কিশোর অপরাধের প্রবণতা দেশজাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। কিশোর অপরাধের প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শান্তি-শৃঙ্খলার অবনতি ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হয়। শিশু কিশোর দ্বারা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাইচাঁদাবাজিপকেটমারের মতো অপরাধ জনগণের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। ছাত্রী অপহরণধর্ষণএসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি কারণে স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধের কারণে সমাজে মাদকাসক্তি ও যৌনাচার বেড়ে চলেছে যা সমাজ জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া কিশোরদের দ্বারা পিতা-মাতা ও বয়োজ্যেষ্ঠদের অবাধ্যতাঅশোভন আচরণপারিবারিক জীবনে শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি কিশোরদের অর্থবহ জীবনকে ধ্বংস করে জাতিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনমূলক কার্যক্রমঃ বর্তমানে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান আছে। বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ সংশোধনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৪৯ সালে ঢাকায় Brostal School প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে কিশোর আদালত এবং টঙ্গীতে কিশোর সংশোধনী প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এ ছাড়া কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য কিশোর হাজতপ্রশিক্ষণ কেন্দ্রপ্রবেশনপ্যারোলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের ওপর গুরুত্বারোপ করে অপরাধী কিশোরদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা। আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক উপায়ে কিশোরদের সংশোধনের ব্যবস্থা করাই এ সকল কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।
কিশোর অপরাধ মোকাবিলার সম্ভাব্য উপায়ঃ কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করে আমাদের সকলের উচিত কিশোরদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনা। কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কিশোররাই দায়ী নয়। এজন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থাপারিবারিক,সামাজিকঅর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। তাই সরকারি প্রচেষ্টা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে-

কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিশোরদের সুষ্ঠু আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যত্নবান হতে হবে।

সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু কিশোরদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে পিতামাতাকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্তানের ভালোলাগার ও মন্দলাগাকে বিচার করতে হবে

কিশোরের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের জন্য গঠনমূলক পারিবারিকসামাজিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

দেশে পর্যাপ্ত কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।

স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো শিশুর মানসিক বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে।
উপসংহারঃ কৈশোরকাল মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের সময়। এ সময় থেকেই মানুষ অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে শুরু করে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কারণে অকালেই সে আশাহত হয়। হতাশা আর নৈরাজ্য জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। কিশোরের সুপ্ত প্রতিভা অঙ্গুরে বিনষ্ট হওয়ায় তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই যে সকল বহুমুখী কারণে কিশোর অপরাধের সৃষ্টি তা রোধ করতে হবে। আমাদের বর্তমান কিশোরদের প্রকৃত মানুষ ও নিরপরাধী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই জাতির উন্নতি সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.