152. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
ভূমিকা: প্রাচীন সভ্যতা হতে শুরু করে আজকের এই নগর সভ্যতার দিকে তাকালে আমরা এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি। এই যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সারাবিশ্বের সর্বত্র আজ বিজ্ঞানের জয় জয়কার। বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রাকে করে দিয়েছে সহজ, বেগবান, সভ্যতায় এনে দিয়েছে পরিপূর্ণতা ও বহুমাত্রিকতা। বর্তমানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি অংশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির
ছোঁয়া আছে। সমাজের যে স্তরে এখনো বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগেনি, সে স্তরে এখনো পর্যন্ত উন্নতি প্রবেশ করতে পারেনি। তাই বলা যায় যে, মানব সভ্যতার উন্নয়নের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান: ইংরেজি Science শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ বিজ্ঞান। Science শব্দটি এসেছে Scio শব্দটি থেকে। যার অর্থ ‘জানা বা শিক্ষা লাভ করা’। বিজ্ঞান শব্দের শব্দগত অর্থ হলো ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমাদের আশেপাশের জীব ও বস্তুজগৎ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিজ্ঞান সম্মত অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত যে বিশেষ জ্ঞান মানুষের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলছে তাকে আমরা বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বজগতের অজানা রহস্য সম্পর্কিত সুসংবদ্ধ জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান।
প্রযুক্তি: প্রযুক্তি শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Technology শব্দটি গ্রিক শব্দ Techne এবং logia থেকে এসেছে। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে বিশেষভাবে ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানে অথবা পূর্ববর্তী সমস্যার উন্নতিসাধনে, সুনির্দিষ্ট কার্যাবলী বিজ্ঞানসম্মতভাবে সম্পন্ন করাই হলো প্রযুক্তি। এক কথায় বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব এবং সূত্রের প্রায়োগিক দিককেই বলে প্রযুক্তি।
উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ: যেদিন প্রথম আগুনের আবিষ্কার হলো, সেদিন থেকেই যেন মানব সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। তারপর থেকেই বিভিন্ন আবিষ্কার এর মধ্য দিয়েই মানব সভ্যতার অগ্রগতি ঘটল। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে। মানুষের কৌতুহলী মন তাকে প্রাকৃতিক নানা বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। তারই ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির আবির্ভাব। এসব বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তি মানুষ তার প্রয়োজনে ব্যবহার করে আসছে।
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী: আমরা অনেকেই আমাদের চারিদিকের পরিবেশের বিচিত্র ঘটনা প্রবাহ অহরহ পর্যবেক্ষণ করে থাকি। কিন্তু সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করেই থেমে থাকেন না। এঁরা প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ ঘটনাগুলো কেনো এবং কীভাবে ঘটে ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত নিবেদিতপ্রাণ, অনুসন্ধিৎসু ও সৃজনশীল এসব ব্যক্তিবর্গকে আমরা বিজ্ঞানী বলি। অনুসন্ধিৎসু গবেষণাধর্মী মনোভাব, বিনয়, সত্যানুন্ধানে আপোষহীন মনোভাব, সহিষ্ণুতা ও সর্বোপরি মানবপ্রেম বিজ্ঞানীদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানব সেবায় এদের অবদান অনস্বীকার্য।
মানব কল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের মূল লক্ষ্যই হলো মানব কল্যাণ। তাই বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করে চলেছেন। তারই কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নিম্নরূপ-
কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। সভ্যতার সূচনালগ্ন হতে মানুষ কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু সেই প্রাচীন কৃষিপদ্ধতির সাথে বর্তমান কৃষিপদ্ধতির ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। কৃষিজ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন, কীটনাশকের ব্যবহার, উন্নতজাতের বীজের ব্যবহার যা অধিক ফলনশীল ইত্যাদির সবকিছুই বিজ্ঞানের ফল। মরুভূমির মতো শুষ্ক বালুময় স্থানেও আজকাল ফসল উৎপাদন করা যায় বিজ্ঞানের কল্যাণে।
শিল্প ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ের শিল্পবিপ্লব মূলত বিজ্ঞানের হাত ধরেই এসেছে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারও বিজ্ঞানের ফল। আগে শিল্প কারখানাগুলো হস্তচালিত থাকলেও বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের দরুণ শিল্পে উন্নতি সম্ভব হয়েছে। এর ফলে শিল্পে যেমন কম সময় লাগছে, কম শ্রম লাগছে, তেমনি উৎপাদনও বেশি হচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা আবশ্যক। শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন উপাদান যেমন, বই, কাগজ, কলম ইত্যাদি সবই শিক্ষার বিকাশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যা প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের আবিষ্কার। এছাড়া বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম ব্যবহৃত বিষয় হলো কম্পিউটার, ইন্টারনেট। যা পড়াশুনাকে করেছে আরো সহজ ও তথ্যসমৃদ্ধ। পড়াশুনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সকল দেশি-বিদেশি বই ও পরামর্শকে সহজলভ্য করেছে ইন্টারনেট, যা বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক আবিষ্কার।
দৈনন্দিন জীবন ও বিদ্যুৎ: দৈনন্দিন জীবনে সর্বদা ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার। এটি মানুষের জীবনযাত্রাকে করেছে সহজ এবং কাজকে আরামদায়ক ও দ্রুতগতিসম্পন্ন করে দিয়েছে। বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব আবিষ্কার বিদ্যুতের মাধ্যমে আরো অনেক বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে যা আমাদের জীবনের পথচলাকে আরো সহজ করেছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী যেমন- লাইট, ফ্যান ইত্যাদি ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও চলতে পারি না। আর এ সমস্ত কিছুই সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের কল্যাণে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আদিম সমাজের মানুষের স্থানান্তরের জন্য পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে চাকাওয়ালা যান এলো এবং এক পর্যায়ে মোটরযান এলো। এগুলো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ স্থাপনে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে যানবাহনের উন্নতির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন বা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে এসেছে টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আজকাল মানুষকে আর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয় না। বরং টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে তা নিজ জায়গায় থেকেও কাজ করা যায়। এরকম আরেকটি যোগাযোগের মাধ্যম হলো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। এটি একটি কৃত্রিম স্যাটেলাইট, যার সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: সর্বাধুনিক পদ্ধতির চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে আজকাল অনেক জটিল ও দূরারোগ্য ব্যধি থেকে মানুষ মুক্তিলাভ করেছে। এমনকি কয়েক বছর আগে যেখানে যক্ষ্মাকে মরণব্যাধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো, তার মুক্তি এখন মানুষের হাতের নাগালে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন, চোখ, কিডনি ইত্যাদির প্রতিস্থাপন, মূত্রথলি, পিত্তথলী প্রভৃতি হতে পাথর অপসারণ, ক্যান্সার নামক ভয়ানক ও মরণব্যাধির বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা সম্ভবপর হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের ওষুধের আবিষ্কারও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরই ফল।
আবহাওয়া ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম একটি অংশ হলো আবহাওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে, বিজ্ঞানীগণ মহাবিশ্বে কৃত্রিম উপগ্রহ বসাতে সক্ষম হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে আমরা যেমন বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখতে পাই, তেমনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাই। বর্তমানে সময় ৭-৮ দিন পূর্বেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে আমরা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগরোধের চেষ্টা করতে পারি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করে, রাডারের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কীকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।
নগর সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: নগর সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নগর সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছাপ স্পষ্ট। নগর সভ্যতা মানব জীবনে নিয়ে এসেছে অনাবিল স্বাচ্ছন্দ ও জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, উন্নত বাড়িঘর, অর্থাৎ প্রকৌশলগত উন্নয়নসহ সব ধরণের নাগরিক সুবিধা ইত্যাদি নগর সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা সম্ভবপর হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে।
মহাশূন্যের জ্ঞান আহরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্য উদঘাটন করতে করতে মানুষের কৌতূহলী মন পৃথিবীকে ছাড়িয়ে মহাশূন্যে পদার্পণ করেছে। যে চাঁদকে নিয়ে একদিন আমরা শুধু কল্পনাই করতাম, সেই চাঁদ এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণেই আমরা এখন মঙ্গলগ্রহে মানব জাতির বসবাস উপযোগী পরিবেশ খুঁজে ফিরছি। এ ছাড়া মানুষ মহাশূন্যে অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ, রোবট ও অন্যান্য আধুনিক ইলেকট্রিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে যার মাধ্যমে মহাশূন্য সম্পর্কে আরো জানা যাবে।
ক্ষতিকারক দিকসমূহ: যদিও বিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানব জাতির কল্যাণসাধন, তথাপি এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। মানুষের ব্যবহারের ভিত্তিতে এর অপকারিতা ও উপকারিতা নির্ধারিত হয়। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে যেসব কলকারখানা স্থাপিত হয়ে বেকার সমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, সেসব কারখানায় আবার আধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহারের ফলেই বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন আবিষ্কার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ফলশ্রুতিতে মানব সমাজের অস্তিত্ব হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফল। আজকের এই দিনে বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ করেই চলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন হলেও এসব দেশকে আর পিছনে ফেরানো যাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর দুই মেরুতে বরফ গলতে শুরু করেছে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকা আমাদের দেখায় বিজ্ঞানের অপব্যবহারকে। বিজ্ঞানের এই অপব্যবহারকে রোধ করে আমরা বিজ্ঞানের সমস্ত কল্যাণকে আয়ত্ত করতে পারি।
উপসংহার: কালের বিবর্তনে মানব জীবন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তেই বিজ্ঞানের অবদান রয়েছে। মানব জীবনে বিজ্ঞানের এই ব্যবহারকে ইতিবাচক দিকেই রাখতে হবে। বিজ্ঞানের আলোয় প্রতিটি মানুষকে আলোকিত করতে হবে। সমস্ত কলুষতা থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত রাখার জন্য সকল ধরণের অপব্যবহার থেকে বিজ্ঞানকে সরিয়ে রাখতে হবে। তবেই মানব সভ্যতার যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব।
No comments