153. সমবায় আন্দোলন
ভূমিকা: আধুনিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অতিপরিচিত এবং পরীক্ষিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাম হলো সমবায়। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ কিংবা ‘বিন্দু থেকে সিন্ধু’ প্রভৃতি বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যগুলোর মূলকথা একটাই আর তা হলো সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন। এ সব স্লোগান বা প্রবাদ বাক্যকে পুঁজি করে বিত্তহীন ও স্বল্পবিত্তের মানুষের সংঘবদ্ধ অর্থনৈতিক ও
সামাজিক উত্তরণের স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে সমবায় আন্দোলন। সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সমবায় আন্দোলনকে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সমবায়
সামাজিক উত্তরণের স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে সমবায় আন্দোলন। সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সমবায় আন্দোলনকে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সমবায় কি: একই বা অভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সমবেতভাবে কাজ করার নামই হলো সমবায়। নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একই শ্রেণি ও পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সমমনা বা একই মানসিকতাসম্পন্ন কিছু সংখ্যক মানুষ যখন একত্রিত হয়ে কোনো সংগঠন বা সংস্থা গঠন করে তখন ঐ সংস্থাকে সমবায় বলে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনৈতিক সংস্থা সমবায়কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ হুভাট ক্যালভাটের মতে ‘সমবায় হলো একটি প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে মানুষ হিসেবে সততা ও সাম্যের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়।’ International Cooperative Alliance-এর মতে ‘সমবায় হচ্ছে এমন কতগুলো লোকের সংস্থা, যাদের আয় সীমাবদ্ধ এবং এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রিত সংগঠনের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হয়ে কোনো সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় তহবিলে ন্যায়ভাবে অংশ প্রদান করে, আর প্রচেষ্টাজনিত ঝুঁকি ও সুযোগ সুবিধার ন্যায্য অংশগ্রহণ করে।’
সমবায় সমিতির প্রকারভেদ: সমবায় সমিতি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। নিম্নে তা ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো-
সমবায়
১) সাধারণ শ্রেণি বিভাগ
-উৎপাদন সমবায়
-ভোক্তা সমবায়
২)কার্যভিত্তিক
-কৃষি সমিতি
-ক্রয় সমিতি
-বিক্রয় সমিতি
-সমবায় সমিতি
-গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি
-বহুমুখি সমবায় সমিতি
-বীমা সমবায় সমিতি
৩) দায়ের প্রকৃতি ভিত্তিক
-অসীম দায় সমিতি
-সসীম দায় সমিতি
৪)সাংগঠনিক
-প্রাথমিক সমবায় সমিতি
-জাতিয় সমবায় সমিতি
-কেন্দ্রিয় সমবায় সমিতি
সমবায় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর হাজার হাজার শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হয়ে কঠিন সমস্যার মুখোমুখী হন। এসময় ইংল্যান্ডের ‘রচডেল’ নামক গ্রামের ২৮ জন তাঁতি ২৮ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম সমবায় সমিতি গড়ে তোলে। ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সমিতি সমবায় আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। ইংল্যান্ডের ‘রচডেল’ গ্রামের এই সমিতিটি পৃথিবীর প্রথম সফল সমবায় হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় সমিতি বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস: বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের ইতিহাসও বেশ পুরনো। এ দেশে সমবায় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্যার পিসি রায়। তিনি খুলনা জেলার পাইকগাছায় রাড়-লী গ্রামের মানুষদের দারিদ্র্য বিমোচন এবং আত্মনির্ভরশীল করার উদ্দেশ্যে এলাকার মানুষদেরকে সমবায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালে সমবায় ঋণদান সমিতি আইন জারি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই আইনের মাধ্যমেই উপমহাদেশের সমবায় আন্দোলনের অভিযাত্রা শুরু। ১৯৪০ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে 'The Bangle Cooperative Society Act'- নামে একটি আইন পাস হয়। সমবায় ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ১৯৮৪ সালে জারি করা হয় সমবায় অধ্যাদেশ। ১৯৮৭ সালে প্রণীত হয় সমবায় নিয়মাবলী।
সমবায় আন্দোলনের মূলনীতিসমূহ: বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের মূলনীতি গুলো হলো- একতা, সাম্য, সহযোগিতা, সততা, আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, সেবা। আন্তর্জাতিক সমবায় এর ক্ষেত্রেও কিছু মূলনীতি রয়েছে এগুলো হলো- স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাধ সদস্যপদ, সামাজিক অঙ্গীকার, সদস্যের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, সদস্যের আর্থিক অংশগ্রহণ, আন্তঃসমবায় সহযোগিতা, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তথ্য।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য এদেশের মানুষের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের আলোকে মূলনীতিসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমবায়ের স্লোগান হলো- ‘একতাই বল’ এবং মূলকথা হলো ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।
বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের জন্য জনসম্পৃক্ত সমবায় আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে সমবায় আন্দোলন অনেক পুরনো হলেও তা এদেশের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আত্মসামাজিক ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি। কিন্তু সমবায়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করতে পারলে জমির মালিক ও কৃষক উভয়েই লাভবান হবে। এজন্য প্রকৃত সমবায়ীদের নেতৃত্বে সমবায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন বেশি করলে তা দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করবে।
খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি সমবায়: বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। সমবায় সমিতি এমন একটি জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে থাকে গণতন্ত্র, সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা, ব্যাপক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ এবং সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস। আধুনিক কৃষির জন্য যে পুঁজি ঝুঁকি এবং যৌথ মেধার দরকার তার জন্য প্রয়োজন গণমুখী কৃষিভিত্তিক সমবায় ব্যবস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হলে কৃষি সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ নীতি এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে কৃষি সমবায় খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে সমবায় প্রতিষ্ঠার নিয়মাবলী: বাংলাদেশের সমবায়গুলো স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন। সমবায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের সমবায় প্রতিষ্ঠার নিয়মগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো-
- নিবন্ধন বা অনুমোদন ছাড়া কোনো সংগঠন কিংবা সমিতি সংঘের নামে ‘সমবায়’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবে না। কেউ তা করলে এক বছরের কারাদন্ডে-দন্ডিত হবেন।
- প্রাথমিক সমবায় সমিতি নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ২০ জন সদস্যের প্রয়োজন।
- প্রত্যেক সমবায় সমিতি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যার স্থায়ী ধারাবাহিকতা আছে।
- সমবায় আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সমবায় সমিতির কমপক্ষে ৭ টি রেজিস্ট্রার হাল নাগাদ সংরক্ষণ করতে হবে।
- সমিতির হিসাব প্রতিবছর অডিট করতে হবে।
- সমবায় আইন, বিধি ও উপবিধি পালন শর্তে সমবায় সমিতির চূড়ান্ত কর্তৃত্ব তার সাধারণ সভার উপর বর্তাবে।
- প্রত্যেক সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আইন বিধি, উপবিধি মোতাবেক গঠিত একটি ব্যবস্থাপনা কমিটির উপর থাকবে।
- সমবায় সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা পরামর্শের প্রয়োজন হলে যেকোনো সমবায় কার্যালয়ে কোনো সমব্যয়ী পরামর্শ করতে পারেন।
- সমবায় আইন ভঙ্গ করলে ৫০০০ টাকা জরিমানা বা ৬ মাসের জেল হতে পারে।
সমবায়ের অপব্যবহার: অনেক সমবায় সমিতি বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা আত্মসাৎ করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে সমবায়গুলোকে নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। এ জন্য সরকার আইন তৈরি করেছে। ২০১২ সালে পাসকৃত আইনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ও পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো সমবায় সমিতি কোনো প্রকার ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবে না। উক্ত আইন ভঙ্গ করলে তাকে ৭ বছরের কারাদন্ডসহ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে।
উপসংহার: দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টিতে অন্যতম এবং উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সমবায়ী উদ্যোগ। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের জন্য, নিজের জন্য সমবায় প্রতিষ্ঠা। All for each and Each for all এই মর্মবাণী ধারণ করে সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের সকলের একান্ত দায়িত্ব।
No comments