212. শহীদ বুদ্ধিজীবী/শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
প্রায় নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন এ দেশের অজস্র মানুষ। তাঁদের মধ্যে
যেসব খ্যাতিমান-বরেণ্য ব্যক্তি শহিদ হয়েছেন, তাঁরাই হলেন শহিদ বুদ্ধিজীবী।এসব শহিদ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সংগীতজ্ঞ ও সমাজসেবক।
নীলনকশা: পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের
নিরীহ ও নিরস্ত্র
মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে
পরিকল্পিতভাবে একে একে হত্যা করে এ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে
পুরো দেশের নানা পেশার মেধাবী মানুষকে হত্যা করার জন্য তারা তালিকা তৈরি করে। এ
দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার,আলবদর, আলশামস
বাহিনীর মাধ্যমে তারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যার এই নীলনকশা বাস্তবায়ন করে।
শহিদ শিক্ষক: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনারা বুদ্ধিজীবী
হত্যার প্রথম ধাপে আক্রমণ চালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন এম মুনিরুজ্জামান। বাড়ি থেকেই তাঁকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে
যায় পাকিস্তানি সেনারা। ওই বাড়িতেই নিচতলায় থাকতেন ইংরেজির খ্যাতিমান অধ্যাপক
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। হানাদার বাহিনী তাঁকেও ধরে নিয়ে যায়। তারপর দুজনকেই নিচের
সিঁড়িতে নিয়ে গুলি করে। এই বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন দর্শনের যশস্বী অধ্যাপক
গোবিন্দচন্দ্র দেব। নিরহংকার, সহজ-সরল এই
জ্ঞানী মানুষটির মুখে হাসি লেগেই থাকত সব সময়। একই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন
ডক্টর গোবিন্দচন্দ্র দেবসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।
শহিদ সাংবাদিক: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের দোসররা জানত, সাংবাদিকেরাও
তাদের জন্য বিপজ্জনক। তাই তারা কয়েকটি সংবাদপত্র অফিসেও ওই রাতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
সাংবাদিক শহিদ সাবের সেই রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন দৈনিক সংবাদ কার্যালয়ে। আগুনের লেলিহান
শিখায় সেই রাতে দগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। শহিদ হন সাংবাদিক সেলিনা পারভীন।
প্রতিভাময়ী কবি ছিলেন মেহেরুন্নেসা। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি শহিদ হন।
শহিদ রাজনীতিবিদ:
মুক্তিযুদ্ধের পুরো
সময়টায়ই চলে এমন অনেক নির্মম হত্যার ঘটনা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন প্রখ্যাত
রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষাকে
রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর
কুমিল্লার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানিরা।
শহিদ সমাজসেবক: ৮৪ বছর বয়সের বৃদ্ধ যোগেশচন্দ্র ঘোষ জীবনের বেশির ভাগ সময়
রসায়নের অধ্যাপনা করেছেন। একসময় তিনি ছিলেন তত্কালীন ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত আয়ুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠানটি ছিল খুব বিখ্যাত। ৭৮ বছর বয়সী রণদাপ্রসাদ
সাহা জন্মেছিলেন গরিবের ঘরে। নিজের চেষ্টায় অনেক বড় হয়েছিলেন। জনহিতকর অনেক কাজ
করেছিলেন বলে তাঁকে বলা হতো দানবীর। চট্টগ্রামের কুণ্ডেশ্বরীর প্রতিষ্ঠাতা বিখ্যাত
সমাজসেবক নূতন চন্দ্র সিংহ। তাঁরা সবাই নির্মম হত্যার শিকার হন।
সংগীতজ্ঞ: ‘আমার ভাইয়ের
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির
সুরকার আলতাফ মাহমুদ। প্রখ্যাত এই সুরসাধক ও সংগীতজ্ঞ পাকিস্তানিদের হাতে
নির্মমভাবে শহিদ হন।
শহিদ বুদ্ধিজীবী:
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে
পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে পাকিস্তানি শাসক চক্র বাংলাদেশকে চিরতরে মেধাশূন্য করার
এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়। তারা এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস
বাহিনীর সহায়তায় চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ
ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের হত্যা করার জন্য নতুনভাবে পরিকল্পনা করে। ১৯৭১ সালের ১০ থেকে
১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা ঢাকার বাড়ি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় দেশের বিশিষ্ট ও
প্রতিভাবান মানুষকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল
হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা; ইতিহাসের
অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ও গিয়াসউদ্দিন আহমদ; ইংরেজির
অধ্যাপক রাশীদুল হাসান। আরও ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহিদুল্লা কায়সার, সাংবাদিক
সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামউদ্দীন
আহমদ ও আ ন ম গোলাম মোস্তফা; খ্যাতিমান
চিকিত্সক ফজলে রাব্বী, আবদুল আলীম
চৌধুরী ও মোহাম্মদ মোর্তজা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়
মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে, কারও কারও
লাশও পাওয়া যায়নি। তাঁদের স্মরণে আমরা প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর ‘শহিদ
বুদ্ধিজীবী দিবস’ পালন করি।
উপসংহার: শহিদদের রক্তে ভিজে আছে বাংলাদেশের মাটি। দেশের জন্য যাঁরা
প্রাণ দিলেন, তাঁরা এ
দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁরা আমাদের অতি আপনজন। যাঁদের প্রাণের বিনিময়ে আমরা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি, আমরা
তাঁদের ভুলব না।
No comments