216. বাংলাদেশের দুর্নীতি ও তার প্রতিকার
ভূমিকা:
বাংলাদেশে যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে সবচেযে মারাত্মক হচ্ছে দুর্নীতি। কারণ, দুর্নীতিই আজ একশ্রেণির মানুষের কাছে প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের উ্চ্চপর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির কালো থাবা বিস্তার লাভ করেছে। দুর্নীতির কারণে জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্চে, অগ্রগতির চাকা পশ্চাদমুখী হচ্ছে। আমাদের এই সামাজিক ব্যাধি সারাতেই হবে। দেশকে
দুর্নীতিমুক্ত করে কাঙ্কিত মুক্তি অর্জন করতেই হবে।
দুর্নীতির সর্বগ্রাসী রুপ:
দুঃখের ও লজ্জায় বিষয় যে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপে পরপর পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় প্রথম সারিতে নিন্দিত অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। দুর্নীতির বিস্তার দেখা যায় সমাজের সর্বস্তরে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বেমালুম হজম করে ফেলা, সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করা, গরিবের জন্য বরাদ্দকৃত ত্রাণের টিন, খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি আত্মসাৎ করা, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস চুরি, আয়কর ফাঁকি, শুল্ক ফাঁকি, চাকরির নামে হায়-হায় কোম্পানি খোলা, চেয়ারচালান, কালোবাজারি, শেয়ারবাজারে কারচুপি, প্রকৃত অপরাধের অভিযোগে থানায় মামলা না নেওয়া, কোথায় নেই দুর্নীতি?এমনকি দুস্থ মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত গম, এতিমদের বস্ত্র, দুর্গত মানুষের জন্য ঢেউ টিন ও খয়রাতি সাহায্য নিয়েও দর্নীতি হয়েছে। উন্নয়নের নামে টেন্ডারবাজি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরিতে নিয়োগ, যোগাযোগ, এমনকি বিচারব্যবস্থায়ও দুর্নীতির আছর পড়েছে। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সাধারণ মানুষ আজ দিশেহারা। মূল্যবোধ, ন্যায়নীতির প্রতি মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। যে দেশের মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, সে দেশের কখনো দুর্নীতির কাছে পরাজিত, হতে পারে না। বাংলাদেশে দুর্নীতির ভয়াবহ ছোবলে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবন জর্জরিত। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ সবকিছুতেই কলষিত করেছি সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। চাঁদাবাজিকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে, টেন্ডারবাজি, টোলবাজি ইত্যাদির মাধ্যমে দুর্নীতি সন্ত্রাসসীর চরিত্র ধারণ করেছে।
দুর্নীতি উন্নয়নের অন্তরায়:
বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দুর্নীতি। সাধারণ মানুষের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্য দুর্নীতির কারণে ম্লান হয়ে যায়।দেশপ্রেমহীন নেতানেত্রী এবং দলতন্ত্রের ফলে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সার্কিভাবে ব্যাহত হচ্ছে; লুন্ঠিত হচ্ছে দেশের মূল্যবান সম্পদ; ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে সেগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশ। জনগণের দুঃখ ও দারিদ্র্য বিমোচন তো দূরের কথা, ক্রমেই বেড়ে চলছে ভূমিহীন দরিদ্র মানুষের সংথ্যা। সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল ধনবৈষম্য।সাম্প্রতিকালে বিভিন্ন সংস্থা ও দাতাদেশ, দুর্নীতিকে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ করণীয়:
আমরা জানি- সন্ত্রাস, কালোটাকা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দুর্নীতিকে দিয়েছে ভয়াবহ ব্যাপ্তি। ফলে সাধারণ মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লঙ্গিত হচ্ছে মানবাধিকার। রাষ্ট্রীয় সংস্থা, সেবাদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে দুর্নীতির অতল গহবরে নিমজ্জিত।এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে-অনেক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশকে এভাবে পতন-পচনের দিকে আমরা ঠেলে দিতে পারি না।
রাজনীতি, অর্থনীতি যেহেতু একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক, তাই সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক দুর্বত্তায়নকে প্রতিরোধ করতে হবে সর্বাগ্রে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দুর্নীতি বিস্তার উন্নত লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়ের ভিত্তিকে মজবুত করতে হবে। দুর্নীতির অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে হলে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, জনপ্রতিনিধি, আমলা, পুলিশ, কর্মচারী, পেশাজীবীদের চিহ্নিত করে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামাজিকভাবে নিন্দিত করতে হবে। দিতে হবে উপযুক্ত শাস্তি। সত্যিকার দেশপ্রেমিক জনদরদিকে নেতা নির্বাচিত করতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের প্রতি সমাজের সব মানুষের ঘৃণা জাগিয়ে দিতে হবে।দুর্নীতিবাজদের প্রতি সমাজের সব মানুষের ঘৃণা জাগিয়ে দিতে হবে।তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।এ আন্দোলনে স্লোগান হতে পারে: ‘দুর্নীতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা কর’, ‘দুর্নীতিবাজদের প্রতিরোধ করার এখনই সময়’।
উপসংহার:
দুর্নীতির মূলোৎপাটনে স্বাধীন দমন কমিশনকে আরো কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। এ কাজে সৎ, নির্লোভ ও দেশপ্রেমিক লোকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। গণমাধ্যম, এনজিও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কালোটাকার মালিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তয়নের পথ রুদ্ধ করতে হয়।দুর্নীতি প্রতিরোধ ও প্রত্যাশিত উন্নয়নের জন্য সুশাসনের বিকল্প নেই।
No comments