92. রানা প্লাজা ট্রাজেডি
ভূমিকা: সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ভবন দুর্ঘটনা হলো সাভারের রানা প্লাজা ধ্বস। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে রানা প্লাজা ধ্বসে ১১৩২ জন শ্রমিক নিহত ও ২৪৩৮ জন আহত হয় যেটি স্মরণকালের ইতিহাসে ভয়াবহ একটি ঘটনা। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। রানা প্লাজা ট্রাজেডিসহ বিভিন্ন ভবন ধ্বস ও কারখানায় অগ্নিকান্ডের কারণে পোশাক শ্রমিকদের মাঝে যেমন নেমে এসেছে আতঙ্ক তেমনি জনজীবনে নেমে এসেছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। ফলশ্রুতিতে বিদেশি মহলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
রানা প্লাজার ইতিহাস: রানা প্লাজা নামে সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এই ভবনটির উদ্বোধন করা হয় ২০১০
সালে। ভবনটি ছিল মোট ৯ তলা। ৩-৮ তলা পর্যন্ত ছিল ৫টি পোশাক কারখানা। দ্বিতীয় তলায় ছিল বিপনিবিতান, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সংস্থা বিজিএমইএ-এর মতে রানা প্লাজার ৫টি কারখানায় কাজ করতেন ৩১২২ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে জানা যায় যে, রানা প্লাজা নির্মাণে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাঁচতলা ভবনের অনুমোদন থাকলেও নির্মাণ করা হয়েছে নয় তলা।
সালে। ভবনটি ছিল মোট ৯ তলা। ৩-৮ তলা পর্যন্ত ছিল ৫টি পোশাক কারখানা। দ্বিতীয় তলায় ছিল বিপনিবিতান, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সংস্থা বিজিএমইএ-এর মতে রানা প্লাজার ৫টি কারখানায় কাজ করতেন ৩১২২ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে জানা যায় যে, রানা প্লাজা নির্মাণে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাঁচতলা ভবনের অনুমোদন থাকলেও নির্মাণ করা হয়েছে নয় তলা।
পোশাক শিল্পের দুর্ঘটনাসমূহ: সম্প্রতি সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে ১১৩২ কর্মী নিহত ও ২৪৩৮ জন গুরুতর আহত হয়। সাভারের দুর্ঘটনা ছাড়াও গত ২ দশকে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় বড় ধরণের অগ্নিকা- ও ভবন ধ্বসের ঘটনা ঘটে। বিজিএমইএর হিসাবে গত ২৩ বছরে পোশাক কারখানায় আগুন লেগে, পদপিষ্ট হয়ে ও ভবন ধ্বসে ১৫১৪ জন শ্রমিক নিহত হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি। নিম্নে একটি তালিকা প্রদান করা হলো।
বছর কারখানার নাম
দুর্ঘটনার ধরন নিহতের সংখ্যা
১৯৯০ সারাকা গার্মেন্টস
আগুনে নিহত
৩০ জন
২০০৫ স্পেকট্রাম গার্মেন্টস
ভবন ধসে নিহত ৬৪ জন
২০০৬ কেটিএস গার্মেন্টস
আগুনে নিহত ৫৫ জন
২০০১২ তাজরীন ফ্যাশন আগুনে নিহত ১১২ জন
২০১৩ রানা প্লাজা
ভবন ধসে নিহত ১১৩২ জন
রানা প্লাজা ট্রাজেডি: ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮ঃ৫৭ মিনিটে ফাটলের কারণে গরীব দুঃখী মানুষের ওপর ধ্বসে পড়লো রানা প্লাজা নামক ভবনটি। আগের দিন ফাটল দেখা দিলে বিজিএমইএ মালিকদেরকে কারখানা বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দেয়। কিন্তু কারখানার মালিক ভয়ভীতি দেখিয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগদান করতে বাধ্য করে। ধ্বসে পড়ার সময় ভবনটিতে কতজন শ্রমিক কর্মরত ছিল তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। তবে বেসরকারি হিসেবে বলা হয় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক ঐ কারখানাটিতে কর্মরত ছিল।
দুর্ঘটনার কারণ: রানা প্লাজা ধ্বসের পিছনে যে বিষয়গুলা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে সেগুলো হলো- ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়নের অভাব, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, রাজউকসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন¦য়ের অভাব, ইমারত নির্মাণ নকশার অনুসরণ না করা, কারখানার মালিকদের উদাসীনতা। মূলত এই সকল কারণেই বাংলাদেশে ভবন ধ্বসের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
উদ্ধার কর্মকান্ড: দুর্ঘটনার পর জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে নেমেছিল ছাত্র, পোশাক কারখানার শ্রমিক, মুদি দোকানীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। খবর শোনামাত্র ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দমকল বাহিনী, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা। তবে সেনাবাহিনী ও দমকল বাহিনীর কর্মীরাই উদ্ধার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দমকলের ২০০ জন কর্মী ও ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধার কর্মকান্ডে অংশ নেয়। ২৮ তারিখ থেকে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে যন্ত্রনির্ভর উদ্ধার কাজ শুরু হয়। ঘটনার ১৭তম দিনে জীবিত উদ্ধার করা হয় রেশমা আক্তার নামে একজন গার্মেন্টস কর্মীকে। ১২ মে পর্যন্ত উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রানা প্লাজা ট্রাজেডির প্রভাব: বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৭৮.৮৬% আসে তৈরি পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে যেটি এদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি রানা প্লাজাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। যার ফলস্বরূপ ২০১৩ সালের ২৮ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে।
রানা প্লাজা ট্রাজেডি ও পোশাক রপ্তানি বাজার: বাংলাদেশ বিশ্বের ২০টির অধিক দেশে পোশাক রপ্তানি করছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৫৬%। এছাড়া কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বাজার। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ভোক্তারা সমবেদনা, উদ্বেগ এবং পণ্য ক্রয়ে অনীহা প্রকাশ করে। সুতরাং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমাদের পোশাক রপ্তানির বাজার ভারত, শ্রীলংকা অথবা চীনারা দখল করে নিবে। আর সেটি হবে আমাদের অর্থনীতির জন্য বৃহৎ ক্ষতির কারণ।
রানা প্লাজা ট্রাজেডির বিচার: রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) রানা প্লাজার মালিকের বিরুদ্ধে ইমারত আইন লঙ্ঘনের জন্য একটি মামলা করে। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। অবশেষে ২৮ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে যশোরের বেনাপোল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া কারখানা অন্যান্য মালিকদেরকেও পরবর্তীতে গ্রেফতার করা হয়। যেহেতু রানা প্লাজার মালিক ঘটনার দিন শ্রমিকদের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করেছিল এবং জাতীয় ইমারত আইন লঙ্ঘন করেছিল সেজন্য তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। যাতে করে এই ধরণের মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
রানা প্লাজা ট্রাজেডি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: রানা প্লাজা ট্রাজেডি আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। ২৯ এপ্রিল জেনেভায় অনুষ্ঠিত পুরো অধিবেশনেই সাভারের ভবন ধ্বসের মর্মান্তিক ঘটনার ছায়া ফেলে। সব দেশের প্রতিনিধিরা সমবেদনা ও শোক প্রকাশ করে। তবে পাশ্চাত্যের কয়েকটি দেশের প্রভাবশালী নেতারা শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করতে না পারার জন্য উদ্বেগ জানিয়ে দ্রুত সংস্কারের তাগিদ দেন।
দুর্ঘটনা প্রতিকারের কিছু পরামর্শ: বাংলাদশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ২০১২-১৩ অর্থবছরে কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৫৪১ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার। সেজন্য আমাদের অর্থনীতি সচল রাখতে আমাদের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। সুতরাং রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিন্মোক্ত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে-
- ভবন নির্মাণের সময় সকল প্রকার নকশা ও ইমারত নির্মাণ আইন মেনে চলতে হবে।
- কারখানা যেন পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে করা হয় এ বিষয়টি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
- পোশাক কারখানায় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও আলো বাতাস চলাচলের জন্য দরজা ও ভেন্টিলেশন থাকতে হবে।
- কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দূর করতে হবে।
- শব্দের তীব্রতা কমানোর জন্য শব্দ নিরোধক যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে।
- বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য মানসম্পন্ন তার ও যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হবে।
- শ্রমিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক অতিরিক্ত কাজ করানো যাবে না।
- কারখানায় পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- সব ধরণের শ্রমিক নির্যাতন বন্ধ করে তাদের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
- দুর্ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
উপসংহার: কিছু লোভী ও স্বার্থান্বেষী মহলের সম্পদের পাহাড় গড়ার মোহের কারণে জীবন বিসর্জন দিতে হচ্ছে এদেশের খেটে খাওয়া মানুষের। রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা অসংখ্য পরিবারকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এগুলোর ব্যাপারে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। শুধু সম্পদ আহরণ নয় শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিও মালিকদের নিশ্চিত করতে হবে।
No comments