93. বাংলাদেশের সাহিত্য
ভূমিকা: যুগ যুগ ধরে মানুষের হৃদয়কে সৃষ্টিশীল কর্ম দিয়ে আন্দোলিত করে চলেছেন কবি সাহিত্যিকরা। জন্ম হওয়া মাত্রই ভাষা পূর্ণতা পায়নি। ভাষার পূর্ণতা এসেছে সাহিত্যিকদের ছোঁয়ায়। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাসের মতো অনন্য সব সৃষ্টি ভাষাকে যেন নতুন জীবন দান করেছে। স্বতন্ত্র এবং পরিপূর্ণ ভাষা হিসেবে বাংলা সাহিত্যের যেমন রয়েছে সমৃদ্ধ ভান্ডার তেমনি বাংলাদেশের সাহিত্যের রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সব কর্ম। সাহিত্যের দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গন রচিত হয়েছে এক অনিন্দ্যসুন্দর প্রেক্ষাপটে। এত
বৈচিত্রপূর্ণ সাহিত্যাঙ্গন দুনিয়ার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বরূপ: এদেশের সাহিত্যের সবুজ অঙ্গন সুশোভিত হয়েছে নানাভাবে। কখনো সাহিত্যের মাঠে মরু বেদুঈনের মতো বিষের বাঁশি হাতে অগ্নিবীনার আগুন ঝরা সুর ছড়িয়েছেন বিদ্রোহের মহাপুরুষ। কখনো বা ঘুমন্ত জাতিকে জেগে উঠার স্বপ্ন দেখিয়েছেন সাত সাগরের মাঝি। মেঠো পথের রাখাল বালক বুনে গেছেন নকশী কাঁথার মাঠে কবরের হৃদয়গ্রাহী বেদনা। কখনো বা কালের কলস হাতে বাংলার সারা মাঠ-ঘাট মায়ের হারিয়ে যাওয়া নোলক খুঁজেছেন বাংলা মায়ের ছেলে। সংসার এবং স্বামী সেবার বাইরেও যে একটা পৃথিবী রয়েছে তা নারীদের জানাতে এগিয়ে এসেছেন বাংলা সাহিত্যের অগ্নিকন্যারা। নারী শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরতে আজীবন লড়াই করে গেছেন রক্ষণশীল সমাজ, গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ঋতু বৈচিত্রের মতোই বিচিত্র সুন্দর এই বাংলাদেশের সাহিত্য। এই সৌন্দর্যের মায়াজালে আবদ্ধ বাংলার গ্রামীন জনপদ, শহরের ব্যস্ত জীবন।
বাংলাদেশের সাহিত্যে নজরুল:
“বল বীর
বল উন্নত মম শীর।”
বাংলা সাহিত্যের অঙ্গণে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব হয়েছিল নজরুলের। কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে বিশ্বমানের প্রতিভা। তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যে ভোরের তারার মতো চিরন্তন ও ভাস্বর। রবীন্দ্র যুগে, রবীন্দ্র প্রতিভার মধ্য গগনে চোখ ঝলসানো দীপ্তির ভেতরে বাংলা সাহিত্যের আর সব কবিরা যখন জোনাকির মতো ম্রিয়মান, বাইশ বছরের ভবঘুরে বাউন্ডুলে যুবক তখন জেগে উঠলেন বিদ্রোহের বিদ্যুৎ দীপ্তিতে। কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনীতে তুলে ধরলেন মানবতা, সাম্য আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধের কথা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তার আপোষহীন মনোভাব তাকে কারারুদ্ধ করিয়েছে। বিদ্রোহের সুর ছিল তার সেখানেও
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেলে কররে লোপাট।”
তার অবিনাশী গান, বিদ্রোহী কবিতা, গজল, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস বাংলাদেশের সাহিত্য ভা-ারকে করেছে সমৃদ্ধ। তার যৌবনের গান, তারুণ্যের দীপ্তি লাখো তরুণের হৃদয়ে জেগে উঠার দামামা হয়ে বাজে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কবির গান কবিতা বারুদের মতো শানিত করেছে যোদ্ধাদের। বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষা ও রপ্ত করেছিলেন বেশ ভালোভাবে। তার অনুবাদ করা রুবাইয়াত-ই ওমর খৈয়াম ও দিওয়ান-ই-হাফিজ আমাদের দেশের অনুবাদ সাহিত্যকে এক অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে। বাঙালি মুসলমানদের রেঁনেসার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার লেখা ও সুর করা ইসলামী এই গানটি যেন আমাদের ঈদের অনবদ্য এক অংশ-
“ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দেয়
কোনো আসমানী তাগিদ।”
বাংলাদেশের সাহিত্যে ইসলামী রেঁনেসা: মুসলিম রেঁনেসার প্রাণপুরুষ কবি ফররুখ আহমদ, বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশের আরেক উজ্জল নক্ষত্র। বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণ, ঐতিহ্য-চেতনা, স্বাধীনতাপ্রীতি ও মানবতাবোধের প্রবল উন্মেষ ঘটেছে তার কবিতায়। ফররুখ আহমদের কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা, রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্প আমাদের সাহিত্যের রঙধনুতে নতুন রঙের পালক লাগিয়েছে। তার লেখা মুসলমানদের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে ভাবতে শেখায়, সোনালি সম্ভাবনার দিকে ধাবিত হওয়ার পথ নির্দেশ করে।
“রাত পোহাবার কত দেরী! পাঞ্জেরী!”
সমস্ত ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জেগে উঠার ডাক পাঠায় তার “সাত সাগরের মাঝি”। তার জাগরণী কবিতা যেন এখনো মিনারের চুড়ায় আযানের ধ্বনির মতো ঘুম ভাঙ্গানোর সুর হয়ে বাজে। বহুমাত্রিক এ কবির ক্যানভাস তাই বিচিত্র ও দিগন্তচারী। তার লেখা গল্প, কবিতা, সনেট, মহাকাব্য, নাট্যকাব্য, গীতি কবিতা বাংলাদেশের সাহিত্য ভান্ডারকে যেন রত্নে ভরে দিয়েছে। কলোত্তীর্ণ এ লেখক যেন আজো আমাদের পথ নির্দেশ করে চলেছেন অন্তরাল থেকে।
বাংলাদেশের সাহিত্যে নারী জাগরণ: এদেশের সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধকরণে নারী সাহিত্যিকদেরও ছিল সরব পদচারণা। আঠারো শতকের মধ্যভাগে বাংলা সাহিত্যে নারী লেখিকাদের আবির্ভাব ঘটে। এসব মহিয়সী নারী সেসময় ঘরে ঘরে নারী শিক্ষার প্রদীপ জ্বেলে গেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাঙালি নারীদের মধ্যে সাহিত্য সৃজনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন নওয়াব ফয়জুন্নেসা। তার সাহিত্য কীর্তি “রূপজালাল” পরবর্তীতে বহু নারীকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের সাহিত্যে জাগরণের পথিকৃৎ বলা হয় বেগম রোকেয়াকে। রক্ষণশীল সমাজের নারী হয়েও তিনি সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে এদেশের নারীদের বোধের জাগরণ ঘটিয়েছেন। তার লেখা “অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ কিংবা সুলতানার স্বপ্ন” যুগ যুগ ধরে নারী সমাজের চোখে আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। ১৯৫২ সালে সরাসরি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী সমাজের অলংকার হয়ে উঠেন সাহসী কন্যা কবি সুফিয়া কামাল। স্বাধীতাপূর্ব সমাজেও তিনি ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ। সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখিয়েছেন মানুষকে। সমাজসেবা ও কলম দুই ই চালিয়ে গেছেন সমান তালে। শ্রদ্ধাভরে আমরা তাকে ডাকি “জননী সাহসিকা”। তিনি প্রভাবিত হয়েছেন একাধারে নজরুল, রোকেয়া, জসীম উদদীন দ্বারা। রবীন্দ্রনাথ তার “সাঝের মায়া” পড়ে তাকে চিঠিতে লিখেছিলেন- “তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং দ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা।” শুধু সাহিত্যে নয়, বাংলাদেশের মানুষের মনে সুফিয়া কামাল দ্রুব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন স্বকীয় স্বভাবগুণে।
বাংলাদেশের সাহিত্যে লোকজ প্রসঙ্গ: বাংলা সাহিত্যে জসীম উদদীন সুপরিচিত পল্লীকবি হিসেবে আর আল মাহমুদ পরিচিত আধুনিক লোকজ কবি। আবহমান বাংলার প্রকৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস তার কবিতায় যেন প্রাণের স্পর্শ পেয়েছে। নদীমাতা বাংলার পরিচিত অথচ চির নতুন কুয়াশার মতো আল মাহমুদের কবিতা। তার লেখা “কালের কলস, সোনালি কাবিন” তাকে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে এক জীবন্ত কিংবদন্তী আখ্যা দেয়। জসীম উদদীনের পরে বাংলাদেশের সাহিত্যকে মাটির কাছে, নদীর কাছে এতটা আর কেউ নিয়ে যেতে পারেনি। তার কবিতার সহজাত ভাব, লোকজ শব্দ পাঠককে যেন গ্রামীণ আবহের মাঝে নিয়ে যায়। জীবন্ত এ কিংবদন্তী লেখক বাংলাদেশের মাটি, মানুষ আর নদীর মতোই সহজ, সুন্দর। তার লেখা সাহিত্য আমাদের বহুকাল ধরে সোঁদা মাটির গন্ধ শুনাবে। পানকৌড়ি বা ডাহুকের মতো তিনি আমাদের প্রকৃতি আর সাহিত্যের অনবদ্য অংশ।
বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিক কাল: বাংলাদেশের সাহিত্যের আধুনিক কাল মুখরিত হয়েছে বহু শক্তিমান লেখকের পদচারনায়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দাঁড় টেনে নিয়ে গেছেন শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন আহমেদের মতো বহুমাত্রিক লেখকেরা। শামসুর রাহমান তার লেখনীতে তুলে এনেছেন আধুনিকতার ছন্দ। হুমায়ুন আজাদের শব্দ চয়ন, উপমার ঢঙ বাংলা ভাষাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আর সহজ-সাবলীল শব্দ, অসাধারণ গল্প, বর্ণনার জাদুকরী শক্তি হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে গেছে পাঠকের খুব কাছে। তার লেখা খুব সহজেই হৃদয়ের অলিগলিতে প্রবেশ করে। “নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার” কিংবা হিমু’র মতো রহস্যময় চরিত্র বাংলা সাহিত্যে আর কেউ সৃষ্টি করে যেতে পারেনি। বাংলাদেশের সাহিত্যের আধুনিক কালকে তাই এককথায় সমৃদ্ধ, বৈচিত্রময় আর পাঠকনন্দিত বলা যায়। এই দুই দশকে সাহিত্য পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ হারে। যা এদেশের সাহিত্যে উজ্জ্বল দিগন্ত সূচনা করেছে।
উপসংহার: বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের মতোই সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সাহিত্য। অসংখ্য প্রতিভাবান সাহিত্যিক অবলীলায় খেলা করেছেন বাংলা সাহিত্যের উন্মুক্ত প্রান্তরে। তাদের সৃষ্টিশীল সাহিত্য কর্মে বাংলাদেশের সাহিত্য পেয়েছে এক অনন্য মর্যাদা। প্রাগৌতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অজস্র নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে বাংলার সাহিত্যাঙ্গন।
No comments