127. সমুদ্র সৈকতে একদিন
ভূমিকা: প্রাকৃতিক রহস্যময় সৃষ্টিগুলোর মধ্যে সমুদ্র অন্যতম। বিশাল সমুদ্রের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অপার রহস্য ও বিস্ময়। এই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে বিস্তৃত বালুকারাশি, নুড়ির প্রবাল আর ঢেউয়ের দোলায়। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি নদীমাতৃক বাংলাদেশের পুরো দক্ষিণ উপকূল জুড়ে সমুদ্রসৈকত থাকলেও দুটি সৈকত বিখ্যাত। এর একটি হলো বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং অপরটি হলো সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার বিস্ময়কর স্থান কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। তাই ভ্রমণপিপাসু ও সৌন্দর্যপ্রেমিক মানুষের কাছে কুয়াকাটা সৈকতই প্রথম পছন্দ। পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এ
পাদভূমি সারা বছরই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
পাদভূমি সারা বছরই পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
কল্পনায় সমুদ্র সৈকত: আমার সৌন্দর্য পিপাসু দুরন্ত মনে ছোটবেলা থেকেই সমুদ্র দর্শনের প্রবল ইচ্ছা ছিল। গল্প, কবিতা, উপন্যাসে সমুদ্রতট সম্পর্কে পড়ে শিক্ষকদের রোমাঞ্চিত বর্ণনা শোনার পর সমুদ্রের বিশালতা সম্পর্কে আমার কিশোর মনে নানা রকম কল্পনা সারাক্ষণ দোলা দিয়ে যেত। আমার কল্পনার চক্ষু সারাক্ষণ খুঁজে বেড়াত মহাসমুদ্রের দীর্ঘ সৈকত, আর বিস্তীর্ণ বেলাভূমি, চোরাবালির ভয়ঙ্কর ফাঁদ, দূর সমুদ্রের গর্জন, নীল সমুদ্রের হাতছানি আরও কত কী! এসবই আমার মনে কল্পনার ফানুস উড়িয়ে আমাকে সমুদ্র ভ্রমণে উৎসাহিত করেছিল।
কুয়াকাটা: পটুয়াখালী জেলার সবচেয়ে দক্ষিণে কলাপাড়া থানা। এই থানার লতাচাপলী ইউনিয়নে কুয়াকাটা অবস্থিত। বাংলাদেশের এই একটা মাত্র জায়গা, যেখান থেকে একই সঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এ এলাকায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী রাখাইন সম্প্রদায়ের বসবাস। রাখাইনদের পেশা হলো সমুদ্র থেকে মাছ ধরে তা বিক্রি করা এবং মাছ শুকিয়ে শুটকি করা। রাখাইন পল্লীতে মাছ শুটকী করার প্রক্রিয়া দেখা যায়। এই এলাকার নাম কুয়াকাটা রাখাইনদেরই দেয়া। বর্মী রাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান প্রদেশ দখল করে নিলে হাজার হাজার রাখাইন বঙ্গোপসাগরের তীরে এ অঞ্চলে এসে বসবাস করতে আরম্ভ করে। তারা স্থানটির নাম দেয় কানসাই, যার অর্থ ভাগ্যকূল। তারপর বৃহৎ আকৃতির কুয়া খনন করার পর মিষ্টি পানি পাওয়া গেলে এলাকার নাম পাল্টে রাখে ‘কুয়াকাটা’। কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ আর সৈকতে রয়েছে বিশাল নারকেল বাগান, গঙ্গামোতির রিজার্ভ বনাঞ্চল, বিশাল কাউয়ার চর।
কুয়াকাটা যাত্রা: তখন আমি যশোর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। স্কুল থেকে বার্ষিক ভ্রমণের জন্য আমাদের শিক্ষকগণ কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। আমি সেই সুযোগ পেয়ে ধন্য হলাম। নির্ধারিত দিনে স্কুলের প্রায় সকল শিক্ষক ও ছাত্র যাত্রা শুরু করলাম কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে। মৃদু বাতাসে সোনালি বিকেলে মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে আমাদের গাড়ি হেলে-দুলে যশোর, খুলনা হয়ে পটুয়াখালীর দিকে এগিয়ে চলল। হালকা ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে ভ্রমণের আনন্দে এবং চাঁদনী রাতের সৌন্দর্যে আমরা বাসের মধ্যে মুগ্ধ মনে পথ চলতে থাকি। মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকদের রোমান্টিক ও হারানো দিনের গান আমাদের রাত জাগাকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। তারপর দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমরা বহু আকাক্সিক্ষত কুয়াকাটা পৌঁছে সমুদ্র সৈকত দেখার আনন্দ উপভোগ করি।
ভোরের সূর্যোদয়ের দৃশ্য: কুয়াকাটায় পৌঁছেই আমরা সমুদ্র তীরবর্তী রেস্টহাউজ ও পর্যটন হোটেলে গিয়ে সকালের হালকা নাস্তা ও চা পান করে শরীরটা চাঙ্গা করে নিলাম। তারপর কাকডাকা ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দের মধ্য দিয়েই সকালে সূর্যোদয় দেখার জন্য সমুদ্রের উপকূলের দিকে এগোলাম। এ সময় সকালের মৃদুমন্দ হিমেল হাওয়া আমাদের মনকে রোমাঞ্চে ভরিয়ে দিল। আমি যখন কল্পনার সাথে বাস্তবের মিল খোঁজার চেষ্টা করছি ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম পূর্বাকাশে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির বুক চিরে টগবগিয়ে রক্তজবার ন্যায় আমার কল্পনার লাল সূর্য চারিদিকে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সূর্যোদয়ের চমৎকার দৃশ্য দেখে আমরা অভিভূত হয়ে যাই। নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সৌন্দর্য উপভোগের পর আমরা পরবর্তী আকর্ষণের দিকে ছুটলাম। কেউ দলবদ্ধ আবার কেউ একাকী নিগূঢ় সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লাম।
দুপুরের রৌদ্রভরা নীলাকাশ: বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈকতের উপকূলে দেশি-বিদেশি বিচিত্র মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। পৃথিবীর জল ও স্থলভাগের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে আমি অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ নয়নে সৈকতের তীরে আছড়ে পড়া বিশাল ঢেউয়ের দৃশ্য উপভোগ করতে থাকি। দুপুর বারোটায় দলের সবাই সমুদ্রস্নানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ ফুটবল খেলা ও বালু মাখামাখি করে সময়টাকে উপভোগ করে। আমরা সবাই কিছু নুড়ি পাথর ও সামুদ্রিক শামুক কুড়িয়ে সমুদ্রস্নান সেরে নিলাম। এমন সময় দুপুরের খাবার প্রস্তুত বলে বাবুর্চি এসে জানিয়ে গেল। আমরা হোটেলে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। অতঃপর সবাই সাময়িক বিশ্রামে গেলে আমি রুমে গিয়ে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী ডায়রিতে লিখতে শুরু করলাম।
বিকালের রোমান্টিকতা: বিকেলে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে পড়ন্ত রোদে সৈকতের পথে হাঁটতে বের হলাম। এ সময় চারপাশের ছবি তুলে আর শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে আমরা কিছুটা সময় পার করলাম। বিকেলে বালুর উপর চিকচিক রোদ এবং দর্শনার্থীদের বৈচিত্রতা আমার হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়ে গেল। এমন সময় পুব আকাশে সাতটি রঙের অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে বিশাল রঙধনু আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে যেন আমাদের বরণ করে নিল। তখন আমার মন গেয়ে উঠলো- ‘কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে।’
সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য: কুয়াকাটার সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য একনজর দেখার জন্য প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়। এ সময় চারিদিকে আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পশ্চিমাকাশে রক্তিম আভায় নীল সমুদ্র আর সূর্যের লুকোচুরি খেলার দৃশ্য যে কারো জন্যই স্মরণীয় মুহূর্ত। এ সময়ের দৃশ্যাবলী ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। বিশাল থালার মতো লাল সূর্য চোখের সামনে সমুদ্রবক্ষে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর কিছু যেন আর নেই।
কুয়াকাটা থেকে প্রস্থান: সূর্যোদয়, দ্বিপ্রহর, বিকাল, সূর্যাস্ত সবই উপভোগ করার পর আমাদের বিদায়ক্ষণ উপস্থিত হলো। আমরা সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। এমন অপরূপ দৃশ্য অবলোকন আর তা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মন একই সঙ্গে আনন্দে ও বিষাদে দোল খাচ্ছিল। আমরা বাসে উঠে নিজ নিজ আসনে বসে পড়লাম। আর জানালায় হাত নেড়ে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সঙ্গে থাকলো কুয়াকাটার স্মৃতি।
উপসংহার: স্মৃতি মানুষকে তাড়া করে ফেরে। আর সেই স্মৃতি যদি হয় আনন্দ আর বেদনামিশ্রিত তাহলে তা হৃদয়ে স্থায়ী দাগ কেটে যায়। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত মাত্র একদিনে আমার মনে যে গভীর ভাবাবেগ সৃষ্টি করে তা সত্যিই বিস্ময়কর। সমুদ্র তার নান্দনিক সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের মনকে সব সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার থেকে পরিশুদ্ধ করে কর্মক্লান্ত হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়। সমুদ্র মানুষকে উদারতা, কোমলতা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ আমার স্মৃতিতে, আমার হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে।
No comments