126. বইমেলা
ভূমিকা: মেলা শব্দটির সাথে আমরা অতি পরিচিত। শত শত বছর ধরে এটি সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে আছে। মেলা যেমন বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে তেমনি এর পৃষ্ঠপোষকরাও হয় বিভিন্ন রকমের। এর মধ্যে বইমেলা সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে নব আবেদন সৃষ্টি করে। বইমেলার প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে সম্প্রতি বইমেলার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বইমেলা পাঠকদেরকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। মানুষের চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানধারণাকে বিস্তৃত করে তোলে, মানুষকে সুখী ও তৃপ্ত করে। বইমেলার মাধ্যমে একটি দেশের সাহিত্য-শিল্প-সাংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়া যায়। এটি জ্ঞানান্বেষী কোটি কোটি মানুষের জ্ঞান-তীর্থ।
বইমেলার ইতিহাস: ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে স্টুর ব্রিজের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ‘বুক সেলার্স রো’ নামে
মেলায় বইয়ের অংশগ্রহণও ছিল। ১৮০২ সালে সর্বপ্রথম নিউইয়র্ক শহরে বইমেলার পূর্ণাঙ্গ আসর বসে। এর উদ্যোক্তা ছিলেন ম্যাথু কেরি। ১৮৭৫ সালে একশজন প্রকাশকের ত্রিশ হাজার বই নিয়ে বইমেলার আয়োজন করা হয় নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে। ১৯৪৯ সালে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ফ্রাঙ্কফুটে। সেখান থেকেই আধুনিক বইমেলার পদযাত্রা শুরু। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ফ্রাঙ্কফুট, লন্ডন, কায়রো, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি বইমেলা জনপ্রিয়তার দিক থেকে শীর্ষস্থানে রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই বইমেলার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলছে। বইমেলা হয়ে উঠেছে অন্যতম আধুনিক সাংস্কৃতিক উপকরণ। এটি বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি বিকাশের অন্যতম ক্ষেত্র।
বাংলাদেশে বইমেলা: ১৯৪৭ সালে মুক্তধারা ও পুঁথিঘর প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে তার প্রকাশিত বই মাটিতে চট বিছিয়ে বিক্রি করেন। তিনি সেগুলোতে বিশেষ ছাড়ও দেন। ১৯৭৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমির কাছে বই বিক্রির অনুমতি চান। ১৯৭৮ সালে বইমেলা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থমেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৫ সালে এই বইমেলার নাম দেওয়া হয় ‘একুশে বইমেলা’। ১৯৯৫ সাল থেকে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগে বইমেলার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বইমেলাকে সফল করতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ভূমিকাও অপরিসীম। এটি উদ্যোক্তা হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের বইমেলা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
লেখক, প্রকাশক ও ক্রেতার সুযোগ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- “কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্ধি করিবে? অতল-স্পর্শ কালসমুদ্রের ওপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে”- আর এই বইয়ের ভান্ডার হলো বইমেলা। ক্রেতারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী বই ক্রয় করতে পারে। বিভিন্ন স্টলগুলোতে ঘুরেফিরে হাতে নিয়ে বই দেখতে পারে। যার ফলে বিভিন্ন অচেনা অজানা বই সম্পর্কে একটু হলেও ধারণা পাওয়া যায়। মেলায় লেখক ও প্রকাশকেরা নতুন জীবনের খোঁজ পায়। তারা বছরের এই সময়টির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে সবার কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। লেখক, প্রকাশক এবং ক্রেতা বইমেলায় এসে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করে। কেউ মুক্ত চিন্তাধারা বিলিয়ে দেয় আবার কেউ তা কুড়িয়ে নেয়।
বই কেনার আগ্রহ বৃদ্ধি: ভিনসেন্ট স্টারেট বলেছেন- ''When we buy a book we buy pleasure'' অনন্ত বিশ্বে জ্ঞান ও ভাবের অপূর্ব সমন্বয় হলো বইমেলা। মেলায় প্রকাশকরা বিভিন্ন স্টল খোলেন এবং নিজেদের পছন্দের বই সাজিয়ে রাখেন থরে থরে। ফলে সেখান থেকে ক্রেতা অতি সহজেই কাঙক্ষিত বইটি কিনে নিতে পারে। বইমেলায় মূল্য ছাড় দেওয়া হয় যা বই ক্রয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অনেক ক্রেতাই বেশি করে বই কেনে। মেলায় লেখক ও প্রকাশকের উপস্থিতি ক্রেতাদের বই কেনার উৎসাহ বাড়িয়ে তোলে। পছন্দের লেখককে হাতের কাছে পেয়ে পাঠক আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। এ সময় অটোগ্রাফ নিতেও কেউ ভুল করে না।
মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশ: পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন- “রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্তযৌবনা যদি তেমন বই হয়।” সেই অনন্তযৌবনা বইটির খোঁজ পাওয়া যাবে বইমেলা নামক বইয়ের রাজ্যে। যেখানে পাঠক রুচিশীল ও মনোরম পরিবেশে পছন্দের বইটি কিনে মনের খোরাক জোগাতে পারবে। বইমেলায় একটি নির্দিষ্ট পরিসরে সব রকম বইয়ের সমাবেশ থাকায় ক্রেতারা অল্প পরিশ্রমে এবং অল্প সময় ব্যয় করে নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী বই সংগ্রহ করতে পারে। বইমেলায় শুধু বই-ই পাওয়া যায় তা নয় বইমেলা হয়ে ওঠে বিনোদন কেন্দ্র। বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান, গানের আসর, কবিতা আবৃত্তির আসর, আলোচনা সভা, মঞ্চ নাটক ইত্যাদি মেলার সৌন্দর্যবর্ধন করে। বইমেলার উন্মুক্ত ও রুচিশীল পরিবেশ পাঠক-দর্শককে বিস্মিত ও আনন্দিত করে।
পারস্পরিক ভাব বিনিময়: বইমেলা হলো মানুষের মিলনমেলা। ব্যস্ত নাগরিক জীবনের একঘেঁয়েমি দূর করে বইমেলা এনে দেয় প্রশান্তি। উন্মুক্ত পরিবেশে ক্রেতারা একে অপরের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি লক্ষ্য করে এবং তা নিয়ে আলোচনাও করে। বড়দের সাথে সাথে ছোটরাও বইমেলাকে দারুণভাবে উপভোগ করে। বইমেলায় প্রকাশকরা সরাসরি পাঠকদের চাহিদার দিকে দৃষ্টি রাখতে পারে এবং চাহিদা অনুযায়ী নতুন বই প্রকাশে উদ্বুদ্ধ হয়। এছাড়া লেখক ও প্রকাশকরা নিজেদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের সুযোগ পান। সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা এবং তা সমাধানের উপায় নিয়েও আলোচনা করেন। বইমেলায় ভক্তরা তাদের প্রিয় লেখকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার সুযোগ পায়।
বইমেলার গুরুত্ব: বই মানুষের পরম বন্ধু, মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাণসভা। বই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে তৈরি করে সেতুবন্ধন। বই সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে মানুষকে বিশুদ্ধ করে তোলে। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন- “আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্যে আমি বইয়ের কাছে ঋণী।” মানুষ জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য বইমেলায় ছুটে যায়। বইমেলায় প্রতিদিনের ব্যস্ততা ভুলে মানুষ আনন্দস্রোতে অবগাহন করে। বইমেলার আসল উদ্দেশ্য হলো বইকেনায় মানুষকে আগ্রহী করে তোলা। লেখক ও নাট্যকার মমতাজউদ্দিন বলেছেন-''The importance of a book fair must be duly
understood by the people of our country, and then we can flourish ourselves'' বইমেলায় বইয়ের সান্নিধ্য ছাড়াও বইপ্রেমীরা পায় সৃষ্টি সুখ। নবীন লেখকদের আত্মবিকাশের উৎসাহ জাগ্রত হয়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। কর্মমুখী মানুষ যারা বই কেনার সময় পায় না তারাও মেলার টানে বইমেলায় গিয়ে হাজির হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে।
বিচিত্র মানুষজন: বইমেলায় বিভিন্ন বয়সের বিচিত্র মানুষের সমাবেশ ঘটে। ক্রেতাদের কেউ কবিতার বই পড়তে পছন্দ করে, আবার কেউ গল্প-উপন্যাসের বই, কেউ নাটকের বই নিয়েই সন্তুষ্ট আবার কেউ ভ্রমণকাহিনী ভালোবাসে। ছোটদের মধ্যে কারও পছন্দ ছড়ার বই আবার কারও মজার মজার ছোট গল্পের বই। ছোট-বড় অনেকেরই গোয়েন্দাকাহিনী প্রিয়। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে ছেলে, বুড়ো, শিক্ষক, জ্ঞানী-গুণী সকলেই বইমেলায় আসে। চোখে পড়ে ছোট শিশুর বইয়ের প্যাকেট হাতে দুরন্তপনা। কোথাও কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জ্ঞানান্বেষীর মন্থর গতি। চা, কফি ও শীতল পানীয়ের দোকানে পাঠক ও দর্শকদের ভিড়।
একুশে বই মেলা: খুব চেনা পরিবেশ, শত প্রাণের উদ্দীপ্ত উপস্থিতি, নতুন বইয়ের গন্ধ এই হলো আমাদের একুশে বই মেলা। ভাষা শহিদদের স্মরণে আয়োজিত বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এই গ্রন্থমেলা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রেরণার উৎস। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বইমেলার ঐতিহ্যমন্ডিত প্রাঙ্গণ এটি। নীরব বাংলা একাডেমী সরব হয়ে উঠবে বইপ্রেমীদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে। ২০১৪ সালে সেই প্রাণস্পন্দন ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহনকারী সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনেও। অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাঙালির বৃহত্তম জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
উপসংহার: জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বইমেলার জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বইমেলায় এসে মানুষ আবিষ্কার করে। একটি মুক্ত পরিবেশ যেখানে তার আত্মার সঙ্গীটির খোঁজ পাওয়া যায়। জীবনের স্বাদ নেয়ার জন্য সকলেই বইমেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তাই সবসময় বইমেলায় দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। আমাদের দেশেও এর জনপ্রিয়তা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
No comments