05. অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা
ভূমিকাঃ যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড আবর্তিত
হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে কৃষিপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল এবং শিল্পজাত পণ্য সামগ্রী
সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে স্থানান্তর করতে সুবিধা হয়। এর ফলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এজন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার
হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থাঃ বাংলাদেশ আকারে ছোট হলেও এখানে নানা রকম বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এদেশে নদী-নালা, খাল-বিল ও হাওড় পরিপূর্ণ বলে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক অমিল রয়েছে। উত্তরাঞ্চলের মানুষ যোগাযোগের জন্য স্থলপথের উপর নির্ভরশীল। আবার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যোগাযোগের জন্য জলপথের উপর নির্ভরশীল। এদেশের আবহাওয়া সব সময় এক থাকে না। বর্ষাকালে দেশের অধিকাংশ জায়গা পানির নিচে চলে যায়। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের এই ভিন্ন বৈশিষ্টের কারণে এখানে নানা ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় সারাদেশকেই যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রকারভেদঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে বিশ্ব আজ যোগাযোগ
ও তথ্য বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছে। মানুষ তার সকল বাধা-বিপত্তি ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে নিজেকে যোগাযোগের মহাসড়কে যুক্ত করছে। বর্তমান বিশ্বে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও উন্নয়ন এখন সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যেসব মাধ্যমগুলো ব্যবহৃত হয় সেগুলো নিচে দেওয়া হলো-
রেলপথঃ বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা হতে জগতী পর্যন্ত ৫২.৮ কিমি রেলপথ চালু হয়। রেলপথ সাধারণত ৩ প্রকারের হয়ে থাকে। এগুলো হলো মিটার গেজ, ব্রড গেজ এবং ডুয়েল গেজ বা মিশ্র গেজ। বাংলাদেশে প্রথম আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হয় ১৯৮৬ সালে। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেল ব্যবস্থার উন্নতির জন্য আলাদা রেলমন্ত্রণালয় গঠিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৪১টি রেল স্টেশন আছে। দেশের রাজধানী, শহর ও বন্দরের সাথে যোগাযোগের জন্য রেল পথের গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ২৮৭৭ কি.মি। এদের মধ্যে ১৮৪৩ কি.মি মিটার গেজ, ৬৫৯ কিমি ব্রড গেজ এবং ৩৭৫ কি.মি হলো ডুয়েল বা মিশ্র গেজ।
সড়ক পথঃ বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের সড়ক পথ গুরত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু আমাদের দেশের সড়ক ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত নয়। বাংলাদেশে সড়ক পরিবহনের সাথে নিয়োজিত সরকারি সংস্থাটির নাম হলো বিআরটিসি। এটি ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে এদেশে ৩৫৭৫ কি.মি জাতীয় মহাসড়ক, ৪৩২৩ কি.মি আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩৬৭৮ কি.মি জেলা রোড রয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও পূর্ণাঙ্গ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব এখনও হয়নি।
নৌপথঃ বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থায় নৌপথের বিশেষ অবদান রয়েছে। নদী-মাতৃক দেশ হওয়ায় অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব সর্বাধিক। বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন সংস্থার নাম হলো ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কতৃপক্ষ’। বর্তমানে বাংলাদেশের নদীপথের দৈর্ঘ্য ৮৪০০ কি.মি। বাংলাদেশে সারা বছর নাব্য নদী পথের দৈর্ঘ্য ৫২০০ কি.মি। নৌপথে স্টিমার, লঞ্চ, কার্গো, ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও সাধারণ নৌকা চলাচল করে। দেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনেও এর অবদান রয়েছে। আমাদের দেশের মোট যাত্রী ও পণ্য সামগ্রীর প্রায় ৭৫ ভাগই নৌপথে পরিবাহিত হয়।
বিমানপথঃ আকাশ পথে বিমানের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যাওয়া সম্ভব। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ৩টি বিমান বন্দর রয়েছে। এগুলো হলো ঢাকায় অবস্থাত হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রামে অবস্থিত শাহ-আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও সিলেটে অবস্থিত ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরটি ১৯৮০ সালে চালু হয়। বাংলাদেশের যশোর, কক্সবাজার, বরিশাল, রাজশাহী,ঈশ্বরদী, সৈয়দপুর এবং ঠাকুরগাঁয়ে অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দর রয়েছে। বাংলাদেশের বিমান পরিবহনের উন্নতির জন্য প্রথম বেসরকারি এয়ারলাইন্স চালু হয় ১৯৯৫ সালের ১৬ জুলাই। বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে অ্যারোবেঙ্গল এয়ারলাইন্স, জিএমজি এয়ারলাইন্স, বেস্ট এভিয়েশন এবং এয়ার পারাবত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমের ভূমিকাঃ শুধু পরিবহন ব্যবস্থার মাঝেই আমাদের যোগাযোগ সীমাবদ্ধ নয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো কিছু মাধ্যম আছে যেগুলো আমরা নিত্যদিন ব্যবহার করে যাচ্ছি। এগুলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করছে। যেমন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া। এই ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া বলতে মোবাইল,টেলিফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদিকে বুঝানো হয়। এই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের ফলে মানুষ ঘরে বসেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর নিতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন গণ মাধ্যম আমাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ডাক ব্যবস্থাঃ ডাক ব্যবস্থা বাংলাদেশের যোগাযোগের সবচেয়ে প্রাচীন মাধ্যম। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭৭৪ সালে ডাক সার্ভিস চালু হয়। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ইসরাইল ব্যতীত পৃথিবীর সকল দেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ডাক বিভাগকে আধুনিক করার জন্য ১৯৮৬ সালে পোস্ট কোড চালু করে। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে ডাকঘরের সংখ্যা ৯৮৮৬ টি।
টেলিফোন ও মোবাইলঃ ২০০১ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ফোন চালু হয় ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারি। ১৯৯২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে কার্ড ফোন চালু হয় এবং ১৯৯৩ সালের ৮ আগস্ট সেলুলার ফোন চালু হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ৬টি মোবাইল ফোন কোম্পানি রয়েছে। সেগুলো হলো- সিটিসেল, গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, টেলিটক এবং এয়ারটেল। বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটক বাংলাদেশ লিঃ ২০০৫ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯.৮৪ কোটি।
টেলিভিশনঃ ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ২টি পূর্ণাঙ্গ সরকারি টেলিভিশন কেন্দ্র এবং ১৪টি উপকেন্দ্র বা রিলে কেন্দ্র রয়েছে। ২০০০ সালে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে ‘একুশে টিভি’ নামে একটি টিভি চ্যানেল খোলা হয়। তবে ইতোমধ্যে অনেকগুলো স্যাটেলাইট বাংলা চ্যানেল এদেশে তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এগুলো হলো- চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, এনটিভি, বাংলা ভিশন, বৈশাখী ইত্যাদি।
বেতারঃ ১৯৪৭ সালে এদেশে মাত্র একটি বেতার কেন্দ্র ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ বেতারের ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। বেতারের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের কার্যক্রমে বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে। এগুলো হলো- বাংলা, ইংরেজি, উর্দু,আরবি ও নেপালি ইত্যাদি। এছাড়াও ১২টি বেসরকারি এফএম রেডিও রয়েছে। গ্রাম অঞ্চলে রেডিওগুলো তাদের বার্তা প্রচার করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া হয় এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে বলা হয়। এভাবে বেতারের মাধ্যমে নানা ধরণের উন্নতি সাধিত হয়।
ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রঃ বর্তমানে বিশ্বে যোগাযোগের জন্য ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। বাংলাদেশে ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের সংখ্যা ৪টি। এগুলো হলো- রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া, গাজীপুরের তালিবাবাদ উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র। ঢাকার মহাখালী এবং সিলেট ভূ উপগ্রহ কেন্দ্র। এদের মধ্যে রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র সর্বপ্রথম ১৯৭৫ সালে চালু হয়।
টেলেক্স, ফ্যাক্স ও ইন্টারনেটঃ বর্তমান যুগে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে দ্রুত সংবাদ আদান-প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। ফ্যাক্সের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো দেশে মুহূর্তের মধ্যে শব্দ, ছবি, ডকুমেন্ট ইত্যাদি প্রেরণ করা যায়। আবার ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। ১৯৯৬ সালে ৪ জুন বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু হয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বঃ যোগাযোগ এবং যাতায়াত ব্যবস্থাকে যেকোনো দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত বলা হয়ে থাকে। যেসব দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত সেসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও উন্নত। কোনো দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষি পণ্যের এবং শিল্পজাত পণ্যের বাজারজাতকরণ, শ্রমিকদের চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবিকার প্রশ্ন জড়িত। পল্লী যোগাযোগের জন্য সড়ক যোগাযোগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগে, দুর্যোগ মোকাবিলা, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং রাজস্ব আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে নৌ-ব্যবস্থার বিকল্প নেই। এছাড়াও সংবাদপত্র আদান-প্রদান, প্রশাসনিক কাজ এবং দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বও কম নয়।
উপসংহারঃ মানবজীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে মানব সম্পদের উন্নয়ন এবং মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। আর এ দুটি বিষয়ই যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা মানুষকে গতিশীল করে। যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নয়নের মূল শক্তি বলা যায় তাই আমাদের দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটাতে হবে।
No comments