02. বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ


পূর্বকথা
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে যে ভাষণ হয়েছিল সেটিই ৭ই মার্চের ভাষণ নামে পরিচিত। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ক্ষমতায় এসে নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করে না।

৭ই মার্চ একটি ঐতিহাসিক ভাষণ 
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) প্রায়
১০ লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি বাঙালির মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ঐতিহাসিক গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। 

ঐতিহাসিক ভাষণের সার অংশ
ভায়েরা আমারআজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়আজ ঢাকাচট্টগ্রামখুলনারাজশাহীরংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়বাংলার মানুষ তার এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম?নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবেআমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব। 

এদেশের মানুষ অর্থনীতিরাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল-ল জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা আমাদের পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্যআজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে-তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি।
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যেআজ থেকে এই বাংলাদেশের কোর্ট-কাচারিআদালত-ফৌজদারিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়,যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য অন্যান্য যে জিনিসগুলির আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশাগরুরগাড়িরেল চলবেলঞ্চ চলবে-শুধু সেক্রেটারিয়েটসুপ্রিমকোর্টহাইকোর্টজজকোর্টসেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তরওয়াপদা কোনোকিছু চলবে না। আর যদি একটি গুলি চলেআর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়-তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলপ্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারিতোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবপানিতে পারব। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারব না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। 

যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে ততদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো-কেউ দেবে না। শুনুনমনে রাখবেনশত্রু পেছনে ঢুকেছেনিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবেলুটতরাজ করবে। এই বাংলায়-হিন্দু-মুসলমানবাঙালিঅবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরআমাদের যেন বদনাম না হয়। 

মনে রাখবেনকর্মচারীরারেডিও যদি আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবেযাতে মানুষ তাদের মাইনে-পত্র নিতে পারে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। 

কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামেপ্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছেতাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।  মনে রাখবারক্ত যখন দিয়েছিরক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। 

উপসংহার
এই ভাষণই বাংলার সন্তানকে বীর করেছে। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। 

No comments

Powered by Blogger.