ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান
বাংলা ভাষার শব্দে দন্ত্য-ন এর মূর্ধন্য-ণ তে পরিবর্তনের নিয়মসমূহকে ণত্ব বিধান এবং দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ তে পরিবর্তনের নিয়মসমূহকে ষত্ব বিধান বলা হয়।
দন্ত্য-ন এর মূর্ধন্য-ণ তে পরিবর্তনের
নিয়মসমূহ
·
ঋ, র, ষ বর্ণের পরে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন- ঋণ, বর্ণ, বিষ্ণু, বরণ, ঘৃণা।
·
যদি ঋ, র, ষ বর্ণের পরে স্বরবর্ণ, ক-বর্গ, প-বর্গ, য, ব, হ অথবা অনুস্বার (ং) থাকে, তার পরবর্তী দন্ত্য-ন
মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। যেমন- কৃপণ, নির্বাণ, গ্রহণ।
·
ট-বর্গের পূর্বের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন- লুণ্ঠন,খণ্ড,বণ্টন,।
·
প্র, পরা, পরি, নির্- উপসর্গের এবং ‘অন্তর’ শব্দের পরে নদ্, নম্, নশ্, নহ্, নী, নুদ্, অন্, হন্- কয়েকটি ধাতুর দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ নয়। যেমন- প্রণাম, পরিণাম, প্রণাশ, পরিণতি, নির্ণয় ইত্যাদি।
·
প্র, পরা ইত্যাদির পর ‘নি’ উপসর্গের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন- প্রণিপাত, প্রণিধান ইত্যাদি।
·
কতগুলো শব্দে স্বভাবতই মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন- কণা, গৌণ, নিপুণ, বাণিজ্য ইত্যাদি।
কোথায় কোথায় ণত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না
·
ত-বর্গযুক্ত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- বৃন্ত, বৃন্দ, গ্রন্থ।
·
বাংলা ক্রিয়াপদের অন্তঃস্থিত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- ধরেন , মারেন, করেন, যাবেন, খাবেন, হবেন, নিবেন, দিবেন।
·
বিদেশী শব্দের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- কোরআন, জার্মান, জবান, নিশান, ফরমান, রিপন।
·
পূর্বপদে ঋ, র, ষ থাকলে পরপদে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- মৃগনাভি, দুর্নাম, ত্রিনেত্র, মৃন্ময়।
·
পদের শেষের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- কর্মন্, ব্রাহ্মন্।
দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ তে পরিবর্তনের
নিয়মসমূহ
·
ঋ-কারে পরে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- ঋষি, বৃষ, বৃষ্টি।
·
অ, আ, বাদে অন্য স্বরবর্ণ, ক এবং র বর্ণের পরের প্রত্যয়াদির দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- ভবিষ্যৎ, পরিষ্কার, মুমূর্ষ।
·
‘অতি’, ‘অভি’ এমন শব্দের শেষে ই-কার উপসর্গ এবং ‘অনু’ আর ‘সু’ উপসর্গের পরে কতগুলো ধাতুর দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- অতিষ্ঠ, অনুষ্ঠান, নিষেধ, অভিষেক, বিষণ্ন(‘ণ্ন’ মূর্ধ-ণ পরে দন্ত্য-ন), সুষম।
·
নিঃ, দুঃ, বহিঃ, আবিঃ, চতুঃ, প্রাদুঃ এ শব্দগুলোর পর ক্, খ্, প্, ফ্ থাকলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- নিঃ + কাম > নিষ্কাম, দুঃ + কর > দুষ্কর, বহিঃ + কার > বহিষ্কার, নিঃ + পাপ > নিষ্পাপ।
·
কিছু শব্দ স্বভাবতই মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- আষাঢ়, নিষ্কর, পাষাণ, ষোড়শ ইত্যাদি।
·
কতগুলো শব্দ বিশেষ নিয়মে মূর্ধন্য-ষ হয়। যেমন- সুষুপ্তি, বিষম, বিষয়, দুর্বিষহ, যুধিষ্ঠির ইত্যাদি।
কোথায় কোথায় ষত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না
·
সাৎ প্রত্যয়ের দন্ত্য-স এর মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন-
·
ভূমিসাৎ, ধূলিসাৎ, আকস্মাৎ।
·
খাঁটি বাংলা ও বিদেশী শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না। যেমন-
·
টেক্স, পুলিশ, জিনিস, মিসর, গ্রিস, স্টেশন, মুসাবিদা।
·
অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ সন্ধিযুক্ত হলে বিসর্গ (ঃ) এর জায়গায় দন্ত্য-স হয়। যেমন-
·
পুরঃ + কার = পুরস্কার, ভাঃ + কর = ভাস্কর, তিরঃ + কার = তিরস্কার, পরঃ+ পর= পরস্পর, স্বতঃ + ফূর্ত= স্বতঃস্ফূর্ত
·
অঃ বা আঃ থাকলে তার পরে ক্, খ্, প্, ফ্ ছাড়াও ত থাকলেও স হতে পারে, যেমন-
·
মনঃ+ তাপ = মনস্তাপ, শিরঃ + ত্রাণ= শিরস্ত্রাণ
ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান-এর প্রয়োজনীয়তা
বাংলা ভাষার যে সব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে সে সব শব্দে সংস্কৃত ভাষার বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে। সংস্কৃত ভাষার বানান ও উচ্চারণ রীতি ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতেরা কোন শব্দের উচ্চারণকে অনায়াস করার জন্য একটি শব্দে পরপর দুইটি ধ্বনিকে কাছাকাছি উচ্চারণস্থলের রাখার চেষ্টা করেছেন। মূর্ধন্য-ণ এবং দন্ত্য-ন-এর উচ্চারণ আপাতশ্রবণে কাছাকাছি মনে হলেও মূর্ধন্য-ণ উচ্চারণ করতে হয় মূর্ধা থেকে আর দন্ত্য-ন উচ্চারণ করতে হয় দন্ত্য থেকে। তাই, যে সব ধ্বনি উচ্চারণ করতে জিহবার অগ্রভাগ দাঁতকে স্পর্শ করে অর্থাৎ ‘ত’-বর্গীয় ধ্বনিগুলো (যেমন ত, থ, দ, ধ) উচ্চারণ করার সময় কাছাকাছি আরেকটি ধ্বনি মূর্ধা থেকে উচ্চারণ না করে দন্ত্য থেকে উচ্চারণ করা সহজসাধ্য। সে কারণে সাধারণভাবে ‘ত’-বর্গীয় ধ্বনির সাথে যুক্ত ধ্বনি দন্ত্য-ন হয়। একই নিয়ম অনুসারে, যে সব ধ্বনি উচ্চারণ করতে জিহবার অগ্রভাগ মূর্ধাকে স্পর্শ করে অর্থাৎ ‘ট’-বর্গীয় ধ্বনিগুলো (যেমন ট, ঠ, ড, ঢ)-র সাথে যুক্ত ধ্বনি মূর্ধন্য-ণ হয়। ঋ, র, ষ উচ্চারণ করতে হয় মূর্ধা থেকে আর তাই এই ধ্বনিগুলোর সাথে যুক্ত ধ্বনি হয় মূর্ধন্য-ণ। এইখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ্য যে, “বণ্টন, লুণ্ঠন”-এই শব্দগুলোর প্রথম মূর্ধন্য-ণ টি ‘ট’-বর্গীয় ধ্বনির সাথে যুক্ত হয়ে উচ্চারিত হচ্ছে, তাই এখানে ণত্ব বিধান ব্যবহৃত হবে, কিন্তু পরের দন্ত্য-ন এর আগে বিরতি থাকায় মূর্ধন্য-ণ হচ্ছে না। ষত্ব বিধান-এর জন্যও একই রকম নিয়ম প্রযোজ্য।
No comments