সাধারণ জ্ঞান বাংলা সাহিত্যের ঐতিহাসিক নাটক ও নাট্যকার
দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর বাংলার প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় ন্যাশনাল থিয়েটার উদ্বোধিত হলে সৃষ্টি হয় এক নতুন ইতিহাস। বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারের (১৮৬০-১৮৭২) সঙ্গে যুক্ত একদল নাট্যপ্রেমিক যুবকের উদ্যোগে কলকাতার একটি বাসভবন প্রাঙ্গণে অস্থায়িভাবে এটি নির্মিত হয়।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ আরও অনেকের সমান্তরালে কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এমন কিছু নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন যা দেশজ ও ইউরোপীয় নাট্যরীতির সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে অতুলনীয়। মিশ্রণটি এতই সূক্ষ্ম যে এতে কোন ফাঁক চোখে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ যে প্রতীকী সাংকেতিক নাট্যরীতির উদ্ভব করেন তা প্রকৃতপক্ষে দেশজ নাটগীত-রীতি এবং ইউরোপীয় নাট্যনির্মাণ কৌশলের সংমিশ্রণ।
গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ আরও অনেকের সমান্তরালে কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) এমন কিছু নাটক রচনা ও পরিচালনা করেন যা দেশজ ও ইউরোপীয় নাট্যরীতির সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে অতুলনীয়। মিশ্রণটি এতই সূক্ষ্ম যে এতে কোন ফাঁক চোখে পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ যে প্রতীকী সাংকেতিক নাট্যরীতির উদ্ভব করেন তা প্রকৃতপক্ষে দেশজ নাটগীত-রীতি এবং ইউরোপীয় নাট্যনির্মাণ কৌশলের সংমিশ্রণ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাট্যচর্চার ধারা বেগবান হয়। কলকাতা কেন্দ্রিক গ্রুপ থিয়েটারের প্রভাবে এখানে বহু নাট্যদল গড়ে ওঠে। তার মধ্যে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ দলগুলি হলো থিয়েটার (১৯৭২), নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় (১৯৬৮, প্রথম প্রযোজনা ১৯৭২), নাট্যচক্র (১৯৭২), আরণ্যক নাট্যদল (১৯৭২), ঢাকা থিয়েটার (১৯৭৩) এবং ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম থিয়েটার ’৭৩ (১৯৭৩), অরিন্দম (১৯৭৪) ইত্যাদি। এ সকল দল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং কমবেশি মাত্রায় নাটকের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সচেষ্ট। দলের সদস্যদের অধিকাংশই ছাত্র-ছাত্রী, বাকিরা বিভিন্ন স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত, কেউই পেশাদার নাট্যশিল্পী নন। তাঁদের অধিকাংশেরই নাট্যকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অথবা পেশাগত দক্ষতা নেই। অফুরন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা আর স্বতঃস্ফূর্ত শৈল্পিক প্রবণতার কারণেই তাঁরা এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে, স্যুভেনিয়ারে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিংবা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির স্পন্সরশিপের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেন। আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাযুক্ত মঞ্চের অভাবে তাঁরা অতি সাধারণ মহিলা সমিতি মঞ্চে তাঁদের নাটক মঞ্চায়ন শুরু করেন। তাঁদের অভিনীত নাটকের বিষয়বস্ত্তর ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে। তাঁরা প্রযোজনা করেছেন ইউরোপ-আমেরিকার বিখ্যাত নাটকের অনুবাদ, রূপান্তর অথবা দলের সদস্য কর্তৃক রচিত মৌলিক নাটক। স্বাধীনতাপূর্ব নাট্যকারবৃন্দের স্থলে এ সময় সম্পূর্ণ নতুন একদল নাট্যকারের আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশিদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল-দীন, মমতাজউদ্দীন আহমদ ও এস.এম সোলায়মান।
আশির দশকে নাট্যচর্চার কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি লক্ষণীয়। যেমন বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক নাট্যকর্মী গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় যোগদান করে অভিনয়, ডিজাইন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে গুণগত উন্নতি সাধন করেন। আশির দশকের শেষ নাগাদ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন শুরু হয়; এ তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০ থেকে), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৬ থেকে) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৯ থেকে)। ১৯৯০ সাল নাগাদ নাট্য শিক্ষাঙ্গন (১৯৭৬) এবং থিয়েটার স্কুল (১৯৯০) নামে ঢাকায় দুটি নাট্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু হয়। সেসময় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বেশ কিছু নাট্যদল পথনাটকের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সে সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারক নাট্য সম্প্রদায়ের জাগো লক্ষ নূর হোসেন, লোক নাট্যদলের রয়াল বেঙ্গল টাইগার এবং দেশ নাটকের মহারাজের গুণকীর্তন। বাংলা নাট্যজগতে অপর এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ‘মুক্ত নাটক’। শহুরে নাটচর্চাকে কেবল মধ্যবিত্তের অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহত্তর শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী জনশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরণ্যক নাট্যদলের নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে শুরু হয় মুক্ত নাটক আন্দোলন। আশির দশকে অপর যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তা হলো শেকড় সন্ধানী প্রচেষ্টা। ইউরোপীয় নাট্য কৌশলের বদলে দেশজ নাট্য আঙ্গিকে জাতীয় নাট্যরীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এক ব্যাপক উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়, যার প্রতিফলন ঘটে নিম্নে বর্ণিত প্রযোজনাসমূহে: ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত ও সেলিম আল-দীন রচিত কেরামত মঙ্গল ও হাত হদাই, খুলনা থিয়েটার প্রযোজিত ও নাজমুল আহসান রচিত মহুয়ার পালা, ঢাকা পদাতিক প্রযোজিত ও এস.এম সোলায়মান রচিত ইংগিত ও এই দেশে এই বেশে ইত্যাদি।
নববইয়ের দশকে পেশাদার নাট্যদল গঠনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হলো: বাংলা থিয়েটার (১৯৯১), থিয়েটার আর্ট (১৯৯২) এবং সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (১৯৯৪)। শেষটি ছাড়া বাকি দুটির প্রয়াস ব্যর্থ হয়। এ দশকের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনায় সরাসরিভাবে রাজনৈতিক সমস্যা অনুপস্থিত। উদাহরণস্বরূপ নাগরিক প্রযোজিত ঈর্ষা, ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত চাকা, ঢাকা পদাতিক প্রযোজিত বিষাদ-সিন্ধু, নাট্যকেন্দ্র প্রযোজিত বিচ্ছু, গণায়ন প্রযোজিত শেষ সংলাপ ইত্যাদি নাটকের নাম উল্লেখ করা যায়।
No comments