224. রাসায়নিক মিশ্রিত খাদ্য ও জনস্বাস্থ্য
ভূমিকা
খাদ্যদ্রব্যকে মনোহর এবং ভোক্তাদের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে নানা ধরনের ভেজাল দ্রব্য সংযোজন করে। এসব পদার্থের মধ্যে অধিকাংশই রাসায়নিক দ্রব্য। এসব রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যদ্রব্যকে মনোহর করে তোলার সাথে সাথে খাদ্যদ্রব্যকে ভোক্তার জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
খাদ্যে রাসায়নিক মিশ্রণ
খাদ্যের বর্ণ মনোহর করা, খাদ্যকে দীর্ঘসময় ব্যবহারোপযোগী রাখার জন্য বা খাদ্যকে কৌটাজাত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ সংমিশ্রণ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব রাসায়নিক পদার্থ
ভোক্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব রাসায়নিক পদার্থ সবসময় মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয়। বরং এসব রাসায়নিক পদার্থ অতিমাত্রায় ব্যবহার করার কারণে মানবদেহে ক্যান্সারের মতো ভয়ঙ্কর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকক্ষেত্রে থেকে যায়।
খাদ্যে সংযোজিত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বিভিন্নভাবে খাদ্যে ব্যবহার করা হয়।
ক) মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ।
খ) মানবদেহে ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ।
গ) প্রাণিদেহে পরিব্যক্তি সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ।
ঘ) প্রাণীর ভ্রূণে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ।
ঙ) খাদ্যে সংযোজিত ধাতব পদার্থ।
চ) খাদ্যে সংযোজিত বিষাক্ত ভেষজ পদার্থ।
ক. মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ
এসব রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যে বিভিন্ন কারণেই সংযোজন করা হয়। কিন্তু যে কারণে এসব রাসায়নিক উপাদান খাদ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, সেই কারণ ছাড়াও এসব রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
১. এসিসালফেমকে: সাধারণ মিষ্টিকারক ও ট্রাইডেন্ট আঠা হিসেবে এটি খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এটি মানবদেহে টিউমার সৃষ্টি করতে পারে।
২. অ্যাসপাটেম: এটি এক ধরনের খাদ্য মিষ্টিকারক। সাধারণত কম ক্যালরিযুক্ত পানীয় ও পুডিংজাতীয় খাদ্যে এটি ব্যবহৃত হয়। গবেষণাগারে ইঁদুরের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এটি মস্তিষ্কে কার্যকারিতায় বাধার সৃষ্টি করে। ব্যবহারকারীরা এতে মাথা ব্যথা, ঝিম ঝিম ভাব ও অনিদ্রাজনিত সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া ও নরওয়েতে এটি নিষিদ্ধ।
৩. বেনজোয়েট: এই রাসায়নিক পদার্থটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই তৈরি করে। সাধারণত বিয়ার কোমল পানীয়, কোনো কোনো ধরনের পুডিং, পাজির ভিত্তি, কোনো কোনো ধরনের পনির তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। হাঁপানি, বিভিন্ন ধরনের র্যাশ, মাইগ্রেন ব্যথা এবং অতিসক্রিয় ভাব প্রদর্শন করে।
৪. বিউটাইলেটেড হাইড্রোক্সিটলুইন: একে সংক্ষেপে বিএইচটি নামে অভিহিত করা হয়। এই রাসায়নিক পদার্থটি সাধারণভাবে তেল, সিরিয়াল, পটেটো চিপস, ইত্যাদিতে অ্যান্টিঅক্সিজেন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এটি ক্যান্সার ও যকৃতের ক্ষতিসাধন করতে পারে। জাপান ও অস্ট্রিয়াতে এটি নিষিদ্ধ এবং যুক্তরাজ্যে এটি শিশু ও যুবকদের খাদ্যে অব্যবহার্য।
৫. ব্রোমিনেটেড ভেজিটেবল তেল: একে সংক্ষেপে বিভিও নামে অভিহিত করা হয়। এটি কোমল পানীয়তে ইমালসিফায়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি চর্বি দ্রবণকারক হিসেবে পরিচিত।
৬. সাইট্রাস রেড ২: এই রাসায়নিক পদার্থটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাকানোর জন্য কমলার খোসায় ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবিষ্ট করা হয়। এটি ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
৭. সাইক্লামেট: এই রাসায়নিক পদার্থটির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হলো অ্যাবট ল্যাবরেটরিজ। এই রাসায়নিক পদার্থটি খাদ্যদ্রব্য সুমিষ্ট করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সারোৎপাদক হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৬৯ সালে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখনো এর প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পুনরায় এর অনুমোদন গ্রহণের জন্য সচেষ্ট।
৮. ডাই, ট্রাই ও পলিফসফেট: সাধারণত ফাস্টফুড, যেমন হ্যামবারগার, সসেজ, প্রক্রিয়াজাত মাংস, হিমায়িত মুরগি, হিমায়িত পিজা, প্রক্রিয়াজাত পনির, ইত্যাদিতে বেশি ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশের গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীর উপর দীর্ঘদিন পরীক্ষা করে এসব রাসায়নিক পদার্থ ক্যান্সারোৎপাদক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
৯. মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট: এই রাসায়নিক পদার্থটি সংক্ষেপে MSG নামে পরিচিত। এটি সাধারণত টিনজাত বা প্যাকেটজাত স্যুপ ও সসে ব্যবহার করা হয়। যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে একে শিশুখাদ্যে ব্যবহারের অনুপযোগী বা নিষিদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি অবসাদগ্রস্থতা, মাথাব্যথা ও বুক ধড়ফড়, ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি করে।
১০.পটাশিয়াম ব্রোমেট: আটা বা ময়দাকে বিরঞ্জিত করার জন্য এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি ‘বেক’ করা বা ভাজার জন্য বেশি ব্যবহৃত হয়। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খাদ্যে এই রাসায়নিক পদার্থটির ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। এর প্রভাবে পাকস্থলিতে ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া হয়।
১১. রেড ৩: ফলের ককটেল, ক্যান্ডি, জিলাটিন ডেজার্ট, পেস্ট্রি এবং পোষা প্রাণীদের খাবার তৈরিতে এই রাসায়নিক পদার্থটি ব্যবহৃত হয়। গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা করে এই রাসায়নিক পদার্থটিকে ক্যান্সারোৎপাদক হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে।
১২.রেড ৪০: এই রাসায়নিক পদার্থটি কোমল পানীয়, ফাস্ট ফুড, এবং প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্যে বেশি ব্যবহৃত হয়। গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা করে এই রাসায়নিক পদার্থ ক্যান্সারোৎপাদক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
১৩. স্যাকারিন: এটি এক ধরনের সংশ্লেষিত মিষ্টিকারক রাসায়নিক পদার্থ। এটি সাধারণত টুথপেস্ট, কোমল পানীয়, মিষ্টিকারক দ্রব্যসহ বিভিন্ন খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই রাসায়নিক পদার্থটির ক্ষেত্রে ‘সতর্কচিহ্ন’ ব্যবহার করা হচ্ছে। গবেষণাগারে বিভিন্ন প্রাণীতে এটি মূত্রথলির ক্যান্সারোৎপাদক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে ১৯৯১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বলেন এটি উচ্চমাত্রায় দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে এটি ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
১৪. সোডিয়াম নাইট্রোইট: এই রাসায়নিক পদার্থটি রান্না করা টিনজাত মাংসে ব্যবহার করা হয়। একে ক্যান্সারোৎপাদক হিসেবে ধারণা করা হয়। সাধারণত এটি হাঁপানি, ভিটামিন বি১ বিনষ্ট করে, জিনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এটি ব্যাকটেরিয়াতে পরিব্যক্তি ঘটায় বলে জানা গেছে।
১৫. সোডিয়াম সালফাইট: হ্যামবারগার, হটডগ, মেয়োনেজ, সস এবং কোমল পানীয়তে এই রাসায়নিক পদার্থটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিক পদার্থের অত্যধিক ব্যবহারে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ভিটামিনের ঘাটতিসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
১৬. মেটানিল ইয়েলো: বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, বিশেষত বোঁদে, আমিত্তি, জিলাপি, কালোজাম, ইত্যাদিসহ কমলা ও হলুদ রঙের মিষ্টি, আইসক্রিম, কোমল পানীয়, ফলের জ্যুস, ইত্যাদিতে এই রং প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডালের বর্ণ উজ্জ্বল করার জন্য এই রং ব্যাপক হারে ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মেটানিল ইয়েলো খুবই শক্তিশালী ক্যান্সারোৎপাদক রাসায়নিক পদার্থ। আলকাতরা থেকে তৈরি এই রাসায়নিক পদার্থটি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১৭. ট্রাই-অর্থো-ক্রিসাইল ফসফেট: এই রাসায়নিক পদার্থটিকে সংক্ষেপে TOCP নামে অভিহিত করা হয়। এটি একটি মারাত্মক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। সাধারণত ভোজ্য তেলে, বিশেষত সরিষার তেলে এই বিষাক্ত পদার্থ মিশানো হয়। এই রাসায়নিক পদার্থের কারণে তেলে এক ধরনের ঝাঁজ সৃষ্টি হয়।
TOCP-এর বিষক্রিয়ায় অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পঙ্গুত্ব দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এই রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ার কারণে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
১৮. রোডামিন বি: এই রাসায়নিক পদার্থটি আলকাতরা থেকে তৈরি করা হয়। এই রং অনেকটা গোলাপি বর্ণের। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, আইসক্রিম এবং কোমল পানীয়ে এই রং মেশানো হয়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে নিষিদ্ধ এই রং দীর্ঘদিন ব্যবহার করা হলে মানুষের যকৃতে ও বৃক্কে ক্ষতি হতে পারে।
১৯. আরাকোলিন: পান-মসলা হিসেবে ব্যবহৃত মুখশুদ্ধিতে এই রাসায়নিক পদার্থ ব্যাপকভাবে মেশানো হয়। বিশুষ্ক সুপারিতেও এ রাসায়নিক পদার্থটি মেশানো হয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা দীর্ঘদিন এই রাসায়নিক পদার্থ দেহে প্রবেশ করলে তা ক্যান্সার রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
২০. সালফিউরিক অ্যাসিড: সালফিউরিক অ্যাসিড একটি মারাত্মক ধরনের ক্ষয়কারী রাসায়নিক পদার্থ। এটি সাধারণত খাদ্যে ব্যবহার করা হয় না। তবে ছানা তৈরির জন্য সাইট্রিক অ্যাসিডের পরিবর্তে অনেক স্থানেই সালফিউরিক অ্যাসিড ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অ্যাসিড দীর্ঘদিন ধরে দেহে প্রবেশ করলে, তা বৃক্ক ও যকৃতের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
২১. ফরমালিন: কাঁচা মাছ, মাংস ইত্যাদি দীর্ঘদিন তাজা রাখার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় মিষ্টি সংরক্ষণের জন্যও ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। ফরমালিন যকৃৎ ও বৃক্কের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে থাকে।
খ. মানবদেহে ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ
কিছু কিছু রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যেসব খাদ্যে বিভিন্ন স্থুল প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এগুলো মানবদেহে ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নিচে ক্যান্সারোৎপাদক এই ধরনের কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থ এবং সেগুলো কোন ধরনের খাদ্যে কি কারণে ব্যবহার করা হয়, তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো -
১. সানসেট ইয়েলো: এই রাসায়নিক পদার্থটি গরম চকোলেট মিক্স, মারজিপান, মোড়কীকৃত স্যুপ, মিষ্টি, দই, ইত্যাদি হলুদ রং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
২. কারময়সিন: এই ক্যান্সারোৎপাদক রাসায়নিক পদার্থটি মোড়কীকৃত জেলি, বাদামি স্যস, মোড়কীকৃত পনির কেক, স্যাভরি মিশ্রণ, পূর্বমোড়কীকৃত স্যুইস রোল ইত্যাদি খাদ্য লাল রং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
৩. উজ্জ্বল নীল: টিনজাতকৃত প্রক্রিয়াজাত মটর বা অনুরূপ ধরনের বীনজাতীয় খাদ্যবস্তু নীল রং করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
৪. অ্যামারান্থ: ক্যান্সারোৎপাদী এই রাসায়নিক পদার্থটি সাধারণত মোড়কীকৃত স্যুপ, মোড়কীকৃত কেক, তরল ভিটামিন সি, মাংসের চাটনি, টিনজাতকৃত ফলের পিঠার পুর, ইত্যাদি লাল রং করার জন্য বহুল পরিমাণে ব্যবহার করা হয়।
৫. ডাইফিনাইল: এই রাসায়নিক পদার্থটি মূলত সংরক্ষণ হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে তাজা কমলালেবু, আঙুর, বিভিন্ন জাতের লেবু, ইত্যাদির খোসা তাজা রাখার জন্য ডাইফিনাইল বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
৬. হেক্সামাইন: এই রাসায়নিক পদার্থটি প্রধানত খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। মেরিনেট করা হেরিং, ম্যাকারেল থেকে তৈরি পানির, ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য টিনজাতকরণ বা মোড়কীকরণের জন্য এই রাসায়নিক পদার্থটি সংরক্ষক দ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৭. সোডিয়াম নাইট্রেট: প্রক্রিয়াজাতকৃত মাংসসামগ্রী, বেকন, হ্যামবারগার, হিমায়িত পিজা, ইত্যাদি লবণে সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাত করার জন্য সোডিয়াম নাইট্রেট প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৮. বিউটাইলেটেড হাইড্রোক্সিঅ্যানিসোল: ক্যান্সারোৎপাদক এই রাসায়নিক পদার্থ সংক্ষেপে বিএইচএ নামে পরিচিত। বিস্কুট, কোমল পানীয়, মার্জারিন, পনির মিশ্রণে ব্যবহৃত চর্বি দুর্গন্ধমুক্ত রাখার জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৯. ক্যারাগ্রিন: এই পদার্থটি আইসক্রিম, পেস্ট্রি, মিল্ক শেক, ফরাহার, ইত্যাদিতে ইমালসিফায়ার এবং ঘনকারক পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১০. সোডিয়াম কার্বোক্সিমিথাইল সেলুলোজ: এই পদার্থটি টিনজাত আলুর সালাদ, হিমায়িত মুস (ফেটানো ও ঠাণ্ডা অবস্থায় পরিবেশিত মাছ, মাংস, স্বাদগন্ধযুক্ত পনির, ইত্যাদি), টম্যাটো সস, পনির, মিষ্টিহীন কমলার স্কোয়াশ, ইত্যাদিতে ঘনকারক পদার্থ ও স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গ. প্রাণিদেহে পরিব্যক্তি সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ
বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ প্রাণিদেহে পরিব্যক্তি সৃষ্টি করতে পারে। এসব রাসায়নিক পদার্থ প্রাণিদেহে যে পরিব্যক্তি ঘটায়, তা বংশপরম্পরায় বাহিত হতে পারে। নিচে কয়েক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো, যেগুলো বিভিন্ন প্রাণীর দেহে পরিব্যক্তি সৃষ্টি করতে পারে।
১. রেড ২জি: এই রাসায়নিক পদার্থটি স্যসেজ, রান্না করা মাংসসামগ্রী, মাংসের চাটনি, ইত্যাদি তৈরি করা খাদ্য লাল রং করার জন্য বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
২. ক্যারামেল: এই পদার্থটি বিস্কুট, আচার, সয়াস্যস, চকোলেট ফলাহার, স্কচ ডিম, ইত্যাদির খাদ্যের রং বাদামি করার জন্য ও খাদ্যের স্বাদ-গন্ধ ভোক্তার কাছে যাতে মনোহর হয়, সেজন্য ব্যবহার করা হয়।
৩. বাদামি এফকে: বাদামি এফকে নামক রাসায়নিক পদার্থটি শুকনো, ধূমায়িত ও লবণ দেওয়া শুঁটকিমাছ, ধূমায়িত ম্যাকারেল, ইত্যাদি বাদামি রং করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
৪. সালফার ডাইঅক্সাইড: টিনজাত ফলের সালাদ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিয়ার, মদ, সিডার (আপেল থেকে তৈরি মদ), শুকনো শাক-সবজি, গুঁড়ো রসুন, হিমায়িত মাশরুম, প্রভৃতির সংরক্ষক হিসেবে সালফার ডাইঅক্সাইডের ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
ঘ. প্রাণীর ভ্রূণে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থ
যেকোনো প্রাণীর ভ্রূণ দশাই তার জীবনেতিহাসে এক মারাত্মক ধরনের নাজুক দশা হিসেবে বিবেচিত। মানুষের ভ্রূণও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। মায়ের দেহ থেকে গর্ভনালী বা আম্বেলিক্যাল কর্ডের মাধ্যমে ভ্রূণ বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, খনিজ পদার্থ, খাদ্যপ্রাণসহ বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থও গ্রহণ করে থাকে। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মায়ের দেহে প্রবিষ্ট বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এই পথেই ভ্রূণে সঞ্চালিত হয়। এসব রাসায়নিক পদার্থ অনেকাংশে মায়ের মূত্রের মাধ্যমে দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়। কিন্তু বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ মায়ের দেহ থেকে অপসারিত না হয়ে সরাসরি ভ্রূণের দেহে গিয়ে পৌঁছায়। ফলে ভ্রূণে মারাত্মক ধরনের সব ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা অনেক সময় গর্ভস্থ ভ্রূণের অকালমৃত্যু ডেকে আনে।
ঙ. খাদ্যে সংযোজিত ধাতব পদার্থ
শুধু রাসায়নিক পদার্থই নয়, খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থও সংযোজন করা হয়। তবে যেসব ধাতব পদার্থ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম উল্লেখযোগ্য। রূপালি-সাদা বর্ণের অ্যালুমিনিয়াম সাধারণত খুবই পাতলা ধরনের ফয়েল হিসেবে খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করা হয়। সন্দেশ, কালোজামসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিজাতীয় পদার্থে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও বর্তমানে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে বিভিন্ন ধরনের রান্না করারও সময় এই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল আবরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অ্যালুমিনিয়াম খুব বিষাক্ত ধাতু। মানবদেহে দীর্ঘদিন সঞ্চিত হলে তা বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
চ. খাদ্যে সংযোজিত বিষাক্ত ভেষজ পদার্থ
অনেক উদ্ভিজ্জ পদার্থ খাদ্যে ভেজাল বস্তু হিসেবে সংযোজন করা হয়। এক্ষেত্রে খেসারি ডালের কথা বলা যায়। খেসারি ডালে মারাত্মক ধরনের জৈব যৌগ রয়েছে। এর নাম বিটা-এন-অক্সালিন অ্যামাইনো-আলফা-অ্যালানিন। সংক্ষেপে এটি NOAA নামে পরিচিত। এই রাসায়নিক পদার্থটি স্নায়ুবিষ যৌগ হিসেবে পরিচিত। এর মূল্য অন্যান্য ডালের চেয়ে কম হওয়ার কারণে বেসন এবং ডালের বড়ি তৈরি করার জন্য খেসারি ডাল প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। অনেকে এই ডাল স্যুপ করেও খেতে পছন্দ করেন। খেসারি ডাল দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে ল্যাথাইরিজম নামক রোগের সৃষ্টি হয়। এই রোগ হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়। এর ফলে পেশির দৃঢ়তা হ্রাস পায়, দেহে দুর্বলতা সৃষ্টি হয় এবং পায়ের মাংসপেশিতে অবশ্যতা সৃষ্টি হয়।
সমাধান
কাঁচা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত বিভিন্ন ধরনের খাদ্যেই বর্তমানে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ সংযোজন করা হয়। ফাস্ট ফুড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যেই বর্তমানে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ সংযোজিত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহে ক্যান্সার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ও উচ্চমাত্রার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এসব সমস্যার সমাধান করা একান্তই প্রয়োজন। তবে এই সমস্যা খুব সহজে সমাধান করা যাবে না। এই কাজ তিনভাবে করা যেতে পারে। প্রথমত এসব রাসায়নিক পদার্থ যেসব খাদ্যে রয়েছে, সেসব খাদ্য গ্রহণ না করা। দ্বিতীয়ত খাদ্যে এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করা এবং তৃতীয়ত আইন করে খাদ্যে এসব রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
এক্ষেত্রে যে সমস্যাটা সবচেয়ে বেশি বিবেচ্য তা হলো, এসব রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারকারীদের অনেকেই হয়তো জানেনই না যে, তারা রং করার জন্য বা স্বাদ তৈরির জন্য বা সংরক্ষণের জন্য যেসব রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যে মেশাচ্ছেন, সেগুলো মানবদেহের জন্য কতখানি ক্ষতিকর। আবার ভোক্তাদের মধ্যেও অনেকেই হয়তো জানেন না, কোন খাদ্যে কি ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মেশানো রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধান করা খুব সহজ কাজ নয়। এজন্য খাদ্য প্রস্তুতকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং খাদ্য গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান উভয়েরই সচেতন হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। একই সাথে প্রয়োজন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও সব ধরনের সচেতন নাগরিকের এই বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রেখে জনসচেতনতা তৈরি করা। কারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা যেমন সহজ নয়, তেমনি সহজ নয় ব্যবসায়ীদের যেনতেন প্রকারে অধিক মুনাফা অর্জনের মানসিকতা বর্জন করা। তবে বিষয়টি একেবারে সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পৃক্ততাও বিশেষভাবে প্রয়োজন।
উপসংহার
বাংলাদেশে খাদ্যসহ বিভিন্ন ব্যবহারযোগ্য বস্তুর মান নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট বা বিএসটিআই নামে একটি সংস্থা স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু খাদ্যে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য অবগত হওয়ার মতো তেমন আধুনিক ব্যবস্থা এখানে না থাকায় খুব সহজেই উৎপাদনকারী অসাধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ আইনের গণ্ডি অতিক্রম করে যেতে সক্ষম হচ্ছেন।
তাছাড়া এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এই বিষয়ে সুস্পষ্ট আইন প্রণয়ন করা আবশ্যক। আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থাসহ কনজ্যুমার এসোসিয়েশনসমূহ যদি দেশের নাগরিকদের মধ্যে এ বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেন, তবে খাদ্যে অহেতুক ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য সংযোজন হ্রাস পেতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে একটি সুষ্ঠু ‘খাদ্যনীতি’ গড়ে তুলতে হবে।
No comments