197.ভাস্কর্যে মুক্তিযুদ্ধ
ভূমিকা: একটি জাতির গৌরব করার মতো যেসব বিষয় থাকে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বাঙালি জাতির অহংকার। বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও অবদান নতুন প্রজন্মকে জানাতে এবং ধরে রাখতে দেশব্যাপী তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ভাস্কর্য যেন তাই খুব
ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।
ভাস্কর্য: ভাস্কর্য এক ধরণের শিল্পকলা বিশেষ। এটি অবশ্যই ত্রি-মাত্রিক হয়। অর্থাৎ একটি ভাস্কর্যের অবশ্যই জ্যামিতি শাস্ত্রের ঘনকের ন্যায় দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা থাকতে হবে। এটি হতে পারে যেকোনো প্রাণী, জীবজন্তু, মানুষ কিংবা অন্য কোনো বস্তুর আদলে। মাটি, পাথর, কাঠ, সুরকি, ধাতব, কংক্রিট ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়ে থাকে। পুতুল, মাটির জিনিসপত্র, মূর্তি, মুখোশ ইত্যাদি ভাস্কর্যের উদাহরণ।
ভাস্কর্য ও মুক্তিযুদ্ধ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে ভাস্কর্যের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালের কয়েকটি ভাস্কর্য যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা দিয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের স্বরণে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করে। মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের স্মৃতিকে লালন করার জন্য এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতার চেতনাকে প্রবাহিত করতেই মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক ভাস্কর্যগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এরূপ স্মৃতিময় ভাস্কর্য রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমনকি বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশেও বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে এরূপ ভাস্কর্য রয়েছে।
পটভূমি: মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূল রচিত হয়েছিল ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে তাৎক্ষণিকভাবে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্বরণে নির্মিত প্রথম ভাস্কর্য। কিন্তু পাকিস্থান সরকার এটিকে গুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে এই শহিদ মিনার স্থায়ী রূপে নির্মাণ করা হলেও বিভিন্ন সময়ে তা হানাদার বাহিনীর আক্রোশের শিকার হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনী এই শহিদ মিনারকে ভেঙ্গে ফেলে। এই ঘটনা মুক্তিযুদ্ধকে প্রভাবিত করে। বাঙালি তরুণ যুব সম্প্রদায়ের হৃদয়ে এই ঘটনা চরম আঘাত হানে। মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হওয়ার পেছনে যেসব ঘটনা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল শহিদ মিনার ভাঙ্গা তার মধ্যে অন্যতম বলে মনে করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার প্রয়াস: বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখা এবং এর বার্তা পরবর্তী প্রজন্মের নিকট পৌঁছে দেয়া হলো ভাস্কর্য নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়া এটি সৌন্দর্য বর্ধনের ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে থাকে। বিভিন্ন সড়কদ্বীপ, শহরের প্রবেশপথ, শিক্ষাঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান, ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানে সাধারণত এরূপ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়ে থাকে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন ধাপ ও পর্যায় তুলে ধরা হয়েছে এসব ভাস্কর্যে। তাই এসব ভাস্কর্য যেন মুক্তিসংগ্রামের জীবন্ত ইতিহাস। ইতিহাসের বাস্তব পাঠশালা হয়ে এসব ভাস্কর্য সবাইকে শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বীর বাঙালি মুক্তিসেনার অবদানকে জাতির নিকট উপস্থাপন করার সবচেয়ে কার্যকরী ও ফলপ্রসূ মাধ্যম হলো এই ভাস্কর্যগুলো।
প্রধান কয়েকটি ভাস্কর্য: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তন্মধ্যে প্রধান কয়েকটি ভাস্কর্যের বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো-
জাগ্রত চৌরঙ্গী: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে জয়দেবপুর সেনানিবাসের বাঙালি সেনারা। এর স্মরণে দেশের প্রথম ভাস্কর্যটি নির্মিাণ করা হয় ১৯৭৩ সালে জয়দেবপুর চৌরাস্তায়। জাগ্রত চৌরঙ্গী নামক এই ভাস্কর্যটির শিল্পী আবদুর রাজ্জাক।
অপরাজেয় বাংলা: এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত। এর নির্মাতা ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী-পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বিজয়ের প্রতীক এই ভাস্কর্য। ১৯৭৩ সালে শুরু হয়ে ১৯৭৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। মূল ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট।
সাবাশ বাংলাদেশ: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ভাস্কর্য এটি। এর শিল্পী নিতুন কুন্ডু। ১৯৯২ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়।
বিজয় কেতন: ঢাকা সেনানিবাসের মূল ফটকে অবস্থিত এই ভাস্কর্যটি। ৭ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বারক এটি, যার একজন নারী হলো পতাকাবাহী।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে অবস্থিত। এটি বিজয়ের প্রতীক। ১৯৮৮ সালে উদ্বোধিত এই ভাস্কর্যের নির্মাতা শামীম শিকদার।
স্বাধীনতা সংগ্রাম: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সর্ববৃহৎ ভাস্কর্য এটি। এই ভাস্কর্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে অবস্থিত। বাঙালির ইতিহাসে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত সমস্ত বীরত্বকে ধারণ করে তৈরি করা হয়েছে এ ভাস্কর্যটি। ১৯৯৯ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়।
মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে। এই ঘটনাকে স্বরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালে এখানে উদ্বোধন করা হয় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ।
জাতীয় স্মৃতিসৌধ: ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। এর স্থপতি মইনুল হোসেন। ১৯৭৯ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। এটি সম্মিলিত প্রয়াস নামে পরিচিত।
রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ: ১৯৭১ সালে রায়েরবাজারের এই এলাকায় ইটের ভাটা ছিল। ডিএনডি বাধের এ অংশে অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের স্মরণে নির্মিত সৌধ।
শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ: এটি ঢাকার মীরপুরে অবস্থিত। ১৯৭৯ সালের ১৪ ডিসে¤¦র দেশের সূর্যসন্তানদেরকে এখানে এনে হত্যা করা হয়। তাঁদের স্বরণেই এই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়।
শিখা অনির্বাণ: শিখা অনির্বাণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সৈনিকদের স্মরণে ঢাকা সেনানিবাসে এটি তৈরি করা হয়েছে।
অন্যান্য: এছাড়াও দেশে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আরও যেসব ভাস্কর্য রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বীরের প্রত্যাবর্তন (বাড্ডা, ঢাকা), প্রত্যাশা (ফুলবাড়ীয়া, ঢাকা), স্বাধীনতা (ঢাকা), সংশপ্তক (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), মুক্তবাংলা (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়), স্মারক ভাস্কর্য (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়), বিজয় ৭১ (বাকৃবি), চেতনা ৭১ (পুলিশ লাইন, কুষ্টিয়া), দূর্জয় (ঢাকা), রক্তসোপান (রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস, গাজীপুর), অঙ্গীকার (চাঁদপুর) ইত্যাদি।
গুরুত্ব: যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্বরণীয় হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। জাদুঘর ও বইয়ের পাতায় সংরক্ষিত ইতিহাসের ন্যায় ভাস্কর্যগুলোও এক একটি ইতিহাস। তাই বাংলাদেশের জাতীয় প্রেক্ষাপটে এই ভাস্কর্যগুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
সমালোচনা: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের নামে যে ভাস্কর্যগুলো করা হয়েছে, এর বিরুদ্ধে সমালোচনাও কম নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্ম ইসলাম। এরূপ ভাস্কর্য নির্মাণ ইসলামের মৌলিক নীতি সমর্থিত নয় বলে এক শেণির মানুষ মনে করেন। এছাড়াও একটি ভাস্কর্য নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যে অর্থের প্রয়োজন হয়, তাও কম নয়। এটিকে অনেকে অপচয় হিসেবে দেখে থাকেন। অনেক সময় এসব ভাস্কর্য যেরূপ অবহেলা ও অযত্নে পড়ে থাকে, দেখলে মনে হয় এর মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মান করার চেয়ে যেন অবমাননাই বেশি করা হয়।
উপসংহার: জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষা এবং ইতিহাস ঐতিহ্য প্রকাশ পায় শিল্পকলার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংগ্রাম, ও চেতনা প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো এদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ভাস্কর্যসমূহ। এসব ভাস্কর্য মহান মুক্তিসংগ্রামের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাঙালিদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়।
No comments