189.সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র
ভূমিকা: প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিরহ-ব্যথা, ঘটনা-দুর্ঘটনার বার্তা বহন করে যে কাগজটি ভোর হতে না হতেই আমাদের দ্বারে প্রবেশ করে তার নাম সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের বহুমুখী কার্যক্ষমতার মধ্যদিয়ে সরকার ও জনগণের মধ্যে এক মৌলিক ও জবাবদিহিতামূলক সেতুবন্ধন তৈরি হয়। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত একটি বিষয় হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ
সংবাদ পরিবেশন, জনমত গঠন ও জনমতের প্রতিফলনের মধ্যদিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। আবার গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবেও সংবাদপত্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
সংবাদ পরিবেশন, জনমত গঠন ও জনমতের প্রতিফলনের মধ্যদিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি পরিস্ফুটিত হয়ে উঠে। আবার গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবেও সংবাদপত্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
সংবাদপত্রের ইতিহাস: চীনদেশে প্রথম সংবাদপত্রের উৎপত্তি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ইউরোপীয় দেশসমূহের মধ্যে প্রথম সংবাদপত্রের প্রচলন শুরু হয়েছিল ইটালিতে। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্রের নাম বেঙ্গল গেটেজ। ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকশিত প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিক দর্শন’। বাংলা ভাষায় প্রথম দৈনিক পত্রিকা ছিল ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’। বাংলা সাময়িকপত্রের মধ্যে তত্ত্বাবোধিনী (১৮৪৩), বঙ্গ দর্শন (১৮৭২), ভারতী (১৮২৩), সবুজপত্র (১৯১৪), বাসনা (১৯০৮), সওগাত (১৯১৮), মোসলেম ভারত (১৯২০), ধুমকেতু (১৯২২), শিখা (১৯২৭) উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে বিভিন্ন নামে দৈনিক সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে মূলক নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের উপর।
আধুনিক সংবাদপত্রের বিষয় বিস্তার: আধুনিক সংবাদপত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সংবাদ পরিবেশনসহ খেলাধুলা, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ক, বাজারদর, গবেষণা, আবহাওয়া, জনমত প্রভৃতি বিষয়ক সংবাদ জায়গা করে নিচ্ছে। কিছু কিছু পত্রিকা বিশেষ বিশেষ ইস্যু নিয়ে পাঠকদের মতামত জরিপ করে তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে থাকে। এসব প্রতিবেদনগুলোর উপর জনগণ ও সরকারের করণীয় প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয। এছাড়া পাঠকদের জন্য রয়েছে আলাদা মঞ্চ বা ফোরাম, যা জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদপত্রের কল্যাণে বিশাল এ পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এবং জনজীবনের প্রায় সবদিককেই তার আওতায় নিয়ে আসতে চাইছে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র: বর্তমানে বেশ কিছু আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে। কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছাড়া একটি সমাজের সামগ্রিক চিত্রের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। Anthony Maskurenhus বলেন-"The Freedom of the newspaper Could
Preserve democracy, Constitutionalism and good governance." সংবাদপত্র একটি সমাজের সামগ্রিক পরিচয়ের প্রাত্যহিক দলিল।
সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ সভ্য সমাজে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় অপরিহার্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সরকারের সাথে জনগণের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে সংবাদপত্র। ফলে সংবাদপত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে জনগণ তাদের স্বাধীনমত অনায়াসে সংবাদপত্রে তুলে ধরতে পারে এবং সরকারও সেই সংবাদগুলো গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে থাকে। ফলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি দেশ ও জনগণ উভয়ের জন্য গুরুত্ববহ হয়ে উঠে এবং দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র: সংবাদমাধ্যমের চূড়ান্ত স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। স্বাধীনতার চর্চার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্বশীলতাও থাকতে হবে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে এই দায়িত্বশীলতা আরও জরুরি। কারণ এখানে প্রথাগতভাবে বিরোধীদল দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে না, তারা নির্বাচিত হলেও সংসদে যায় না। সংসদে গেলেও জনগণের সমস্যা নিয়ে সোচ্চার থাকে না। নিজেদের রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ফলে সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি জনগণের কথা নিয়ে সরকারের কাছে সংবাদমাধ্যমকেই যেতে হয়। কার্যকর ও বিরোধীদলের অনুপস্থিতে সংবাদ মাধ্যমকেই বিরোধী দলের দায়িত্ব নিতে হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে অবস্থান নিতে হয় সংবাদ মাধ্যমকেই।
সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হলেও গত ৪২ বছরে এই সংবিধানে ১৫টি সংশোধনী সংযুক্ত হয়েছে। তবে সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদটি যেভাবে ছিল তা রয়ে গেছে। সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। এই অনুচ্ছেদের ৩৯ (২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটো আরও স্পষ্ট। ‘ক’ তে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা’ এবং ‘খ’ তে বলা হয়েছে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চয়তা দান করা হইল’।
সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা: দেশের অগ্রযাত্রার জন্য যেমন স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রয়োজন তেমনি সাংবাদিকের স্বাধীনতা ছাড়াও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম অসম্ভব। একজন স্বাধীনচেতা সাংবাদিক, যিনি কোনো পক্ষভুক্ত নন, তার জন্য প্রয়োজন এমন সংবাদপত্র যেখানে পেশাদারিত্ব চলবে, মালিকের হস্তক্ষেপ নয়। সাংবাদিকতা গণতন্ত্রের অনুষঙ্গ। তাই বলা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ সাংবাদিকের ভূমিকা অনুস্বীকার্য।
সংবাদপত্রের অবাধ স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা: সংবাদপত্র সমাজের ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকান্ডের প্রতিচ্ছবি এবং সাংবাদিকগণ জাতির সর্বাধিক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত বাধ্য-বাধকতা সাপেক্ষে সংবাদপত্র স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবে বিকৃতি করে খবর প্রকাশ করার সুযোগ নেই। সংবাদপত্রে স্বাধীন সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। ১. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নত হয় এমন খবর প্রকাশ করা যাবে না। ২. বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে এমন বক্তব্য ছাপানো যাবে না। ৩. যে সংবাদ প্রকাশ করলে শালীনতা বা নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং যাতে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ নিহিত আছে তা সংবাদপত্রে প্রকাশযোগ্য নয়। ৪. জন-শৃঙ্খলা বিঘ্নত হয় এমন বিষয় যতই ছাপানো যাবে না। ৫. আদালত অবমাননা হয় এমন বক্তব্য প্রকাশ করা যাবে না। ৬. কারো মানহানি ঘটে এমন বিষয় এড়িয়ে যেতে হবে। ৭. অপরাধ সংগঠনে প্ররোচণা যোগায় এমন বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সরকারের ভূমিকা: সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। রাষ্ট্র ও সরকারকে সঠিকবাবে পরিচালনায় মিডিয়া ও সংবাদপত্রের সহায়তা ও ভূমিকার বিকল্প কিছু নেই। সরকার ভুল করলে কিংবা জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সংবাদপত্র সেটি জনসম্মুখে তুলে ধরে জনসচেতনতা ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবেশ সৃষ্টিতে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তাই বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাদানে কুণ্ঠিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অথচ আমাদের দেশে সংবাদপত্র স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার বিষয়টি মুখ্য হিসেবে বিবেচনা না করে, সংবাদপত্র ও প্রেস রাষ্ট্রশক্তির রোষানলে পড়ে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। সত্য প্রকাশে সম্পাদককে মাঝে মাঝে ‘লিমিটেশন’ বজায় রাখতে হয়।
উপসংহার: গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোনো বিকল্প নেই। জনগণের সাথে সরকারের মেলবন্ধন ঘটিয়ে দেয় সংবাদপত্র। তাই গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় রাখতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। সংবাদপত্রে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করুক, সরকারের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিক, সমাজে সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।
No comments