183. মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠরা
ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব, আত্মত্যাগ আর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট জয় করার এক বড় ক্যানভাস এই মুক্তিযুদ্ধ। যে ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছিল সাত কোটি বাঙালির মুক্তির মহাসনদ। যেসকল সাহসী, আত্মত্যাগী ও দেশপ্রেমিক সন্তানদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা তাদের মধ্যে সাতজনকে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এই
সূর্য সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য ছিনিয়ে এনেছিল লাল সবুজের পতাকা।
সূর্য সন্তানেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য ছিনিয়ে এনেছিল লাল সবুজের পতাকা।
বীরশ্রেষ্ঠ সম্মাননা যেভাবে এলো: “বীরশ্রেষ্ঠ” হলো বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে এই পদক দেয়া হয়েছে। গুরুত্বের ক্রমানুসারে বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের অন্যান্য সামরিক পদক হলো- বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরই এই পদকগুলো দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গেজেটের একটি অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপ্তির মাধ্যমে এই পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ সাতজন: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণোৎসর্গকারী বীরশ্রেষ্ঠরা হলেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ, মোহাম্মদ হামিদুর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। তাদের পরিচয় এবং অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর: ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল মোতালেব হাওলাদার। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়ানে কর্তব্যরত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে অনেকটা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন। বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে। শহিদ হন তিনি। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে।
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান: মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তদানিন্তন যশোর জেলার মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আব্বাস আলী মন্ডল। ১৯৭০ সালে হামিদুর যোগ দেন সেনাবাহিনীতে সিপাহী পদে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের চাকরিস্থল থেকে নিজ গ্রামে চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য চলে যান সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে। অক্টোবরের ২৮ তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০-এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে। সফলভাবে গ্রেনেড হামলা করে ফিরে আসার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি এবং শাহাদাতবরণ করেন। হামিদুর রহমানের মৃতদেহ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমের ছড়া গ্রামে দাফন করা হয়। ২০০৭ সালের ২৭ অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করে। ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল: মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাবিবুর রহমান। ১৯৬৭-র ১৬ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। সেখানে ১৬ এপ্রিল শত্রুবাহিনীর সাথে এক সম্মুখযুদ্ধে সহযোদ্ধাদের নিরাপদে সরে যেতে সুযোগ তৈরি করার জন্য শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পরেন সিপাহি মোস্তফা কামাল। এক পর্যায়ে তার মেশিনগানের গুলি ফুরিয়ে গেলে শত্রুর গুলিতে শহিদ হন তিনি।
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন: রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার বাঘচাপড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর পিতা আজহার পাটোয়ারী। এসএসসি পাশ করে ১৯৫৩ সালে তিনি জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে আর্টিফিসারি পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম পি.এন.এস বখতিয়ার নৌ-ঘাটিতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ঘাটি থেকে পালিয়ে যান, যোগ দেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর 'পদ্মা', ‘পলাশ’ এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট ‘পানভেল’ খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌ-ঘাটি পি.এন.এস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে অনেক উচুঁ থেকে তিনটি জঙ্গি বিমান গানবোটগুলোতে হামলা চালায়। বিধ্বস্ত গানবোট এ মারাত্মক আহত হন তিনি, সাতরে তীরে আসলেও স্থানীয় রাজাকারদের হাতে শহিদ হন এই বীর সেনানি।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান: ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ। ১৯৬১ সালে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে কমিশন লাভ করেন এবং জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। ২৫ মার্চের ঘটনায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। তিনি কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২০ আগস্ট সকালে করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাটি থেকে একটি জঙ্গি বিমান ছিনতাই করেন। এক পর্যায়ে বিমানে থাকা অন্য পাকিস্তানি পাইলটের সাথে ধস্তাধস্তিতে বিমানটি ভূপাতিত হয় এবং তিনি শহিদ হন। ২০০৬ সালের ২৩ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৫ জুন শহিদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ: ১৯৪৩ সালের মে মাসে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। তাঁর পিতার নাম মুন্সি মেহেদী হোসেন। ১৯৬৩ সালের ৮ মে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ ভর্তি হন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং এ কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন। ৮ এপ্রিল ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার জন্য যান। সেখানে পাকিস্তানি শত্রুদের স্পীড বোটে স্বশস্ত্র হামলা চালান তিনি। এতে স্পীড বোট ডুবে যায় এবং বেশকিছু শত্রু ঘায়েল হয়। দুটো লঞ্চ দ্রুত পেছনে গিয়ে শুরু করে দুরপাল্লার ভারী গোলাবর্ষণ। মর্টারের ভারী গোলা এসে পরে আব্দুর রউফের উপর। এভাবেই লুটিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন এই বীরশ্রেষ্ঠ।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ: ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ। ১৯৫৯-এর ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর-এ যোগদান করেন। এরপর তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন। ১৯৭১-এর ৫ সেপ্টেম্বর সুতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষার সামনে যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আহত সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন নূর মোহাম্মদ। এরপর বাকি মুক্তিযোদ্ধাসহ আহতদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে একাই অধিনায়কের মত ঠেকিয়ে রাখেন পাক বাহিনীকে। এক পর্যায়ে গুলি ফুরিয়ে আসলে শত্রুর বেয়োনেটের নির্মম আঘাতে শহিদ হন এই বীরশ্রেষ্ঠ।
উপসংহার: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার স্থানীয় দোসর জামায়াতে-ইসলামী, আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন বাংলার আপামর জনসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য ৭ জন শহিদ মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বীরত্বের খেতাব-বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি প্রদান করা হয়।
No comments