172. বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের ভূমিকা
ভূমিকা: আধুনিক সভ্যতার যুগে মানুষের অস্তিত্বের সাথে যতগুলো বিষয় জড়িত আছে তার মধ্যে বিদ্যুৎ অন্যতম। সভ্যতার উন্নতির ধারায় বিদ্যুতের ভূমিকা অপরিমেয়। বর্তমান আধুনিক জীবনের এমন কোনো দিক নেই যেখানে বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগেনি। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের জীবনে নতুন ছন্দ যোগ হয়েছে। বর্তমান সভ্যতার ক্রমবিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারের কারণে বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক জীবন
কল্পনা করা যায় না। বিদ্যুতকে তাই বলা হয়ে থাকে আধুনিক জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি।
কল্পনা করা যায় না। বিদ্যুতকে তাই বলা হয়ে থাকে আধুনিক জীবনের অন্যতম চালিকাশক্তি।
বিদ্যুতের আবিষ্কার: বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাস পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও বৃটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্টকে বলা হয় বিদ্যুতের আবিষ্কারক। তিনি ১৫৭০ সালে প্রথম বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেন। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে আরো বেশ কিছু বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নাম- আলেসান্দ্রো ভোল্টা, লইগি গ্যালভানি, মাইকেল ফ্যারাডে ও টমাস আলভা এডিসন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিদ্যুতের বিভিন্ন দিক উদ্ভাবন করেছেন। ১৮৭৮ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করে সভ্যতার অগ্রগতিতে অন্যরকম এক মাত্রা যোগ করেন।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ: আবিষ্কারের পর থেকেই খুব দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎ। এর ক্রমধারায় এক সময় বাংলাদেশেও শুরু হয় বিদ্যুতের ব্যবহার। ১৯০১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো বিদ্যুৎ জ্বলে উঠে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে। এরপর থেকে ব্যাপকভাবে শুরু হয় সর্বক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, চিকিৎসা, কৃষি, সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রের মূল চালিকাশক্তি এখন বিদ্যুৎ। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাইতে অবস্থিত। যেটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে।
বিদ্যুৎ ও আধুনিক জীবন: আধুনিক সভ্য জীবনের সাথে বিদ্যুতের একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আধুনিক জীবন চলতে পারে না। কাজেই আধুনিক প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি এখন মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। আর বিদ্যুতের সাহায্য ছাড়া এসব যন্ত্রপাতি পুরোপুরি অচল। বিদ্যুতের আগমনের ফলে জীবনের সবক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আধুনিক জীবনে মানুষকে চরম সার্থকতা এনে দিয়েছে বিদ্যুৎ। বর্তমানে মানুষ এতটাই বিদ্যুৎ-নির্ভর যে বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া জীবনের সমস্ত গতি মুহূর্তেই থেমে যায়।
দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ: দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া মানুষের একটি দিনও চলে না। বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, টেলিফোন, মোবাইল, রেডিও, টেলিভিশন সবকিছুই বিদ্যুৎ শক্তির করুণায় মানুষকে সেবা দিতে পারে। বিদ্যুৎ আছে বলেই মানুষ এখন রাতের অন্ধকারকে আলোকিত করতে পারে। রান্নার কাজেও এখন ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ। বৈদ্যুতিক হিটার, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার সব কিছুই এখন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। গরমের চরম অস্বস্তির অবসান ঘটিয়ে মানুষকে প্রশান্তির পরশ এনে দিচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখা ও এয়ারকুলার। এছাড়াও উঁচু দালান ও অট্টালিকায় ব্যবহৃত হয়-বৈদ্যুতিক লিফট, যাতে করে অল্প সময়ে এবং বিনা পরিশ্রমে উঠা-নামা করা যায়।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ: যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ নতুন গতি যোগ করেছে। বিদ্যুতের কল্যাণে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সমস্ত দূরত্ব দূর করে দেওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিদ্যুৎ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় সংবাদপত্র। পুরো পুথিবীর খবরাখবর চলে আসে হাতের মুঠোয়। তাছাড়া টেলিফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তেই যোগাযোগ করা যায় বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের সাথে। দ্রুতগামী বৈদ্যুতিক ট্রেন পরিবহন ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছে চরম উৎকর্ষতা। বিদ্যুতের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে আধুনিক বিমান ও জাহাজ নির্মাণ শিল্প। বন্দর ও স্টেশনে ভারী মালামাল উঠানো ও নামানোর জন্য যে ‘কপিকল’ ব্যবহার করা হয় তারও শক্তির উৎস হচ্ছে বিদ্যুৎ।
উৎপাদন ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ: বিদ্যুতের কল্যাণে বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থা সাফল্যের চরম শিখরে উঠতে শিখেছে। বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কলকারখানাগুলো এখন দ্রুত উৎপাদনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। পানির জন্য এখন কৃষকদের প্রকৃতির দয়ার আশায় বসে থাকতে হয় না। বৃষ্টি না হলেও তারা তাদের কৃষিক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক মেশিন ব্যবহার করে পানি সেচ দিতে পারে। এর ফলে তাদের উৎপাদনের পরিমাণও আগের চেয়ে অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি ব্যবস্থায় যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বর্তমান পৃথিবীতে উৎপাদনের ব্যাপক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। কারণ প্রযুক্তিগত বিশাল বিশাল যন্ত্রগুলোকে সে মানুষের দাসে পরিণত করেছে।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ: আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের যে উন্নতি সাধিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে বিদ্যুতের অপরিসীম ভূমিকা। বিদ্যুতের সাহায্যে বর্তমানে নিখুঁতভাবে যেকোনো রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে। বিদ্যুৎ আছে বলেই এখন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সব ধরণের রোগ ও তার সঠিক প্রতিকার সনাক্ত করা যায়। বিদ্যুতের আগমনের কারণে মানুষ অনুমাননির্ভর চিকিৎসা থেকে মুক্তি পেয়েছে। এছাড়া বর্তমানে বৈদ্যুতিক রশ্মির সাহায্যে বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাও সম্ভব হচ্ছে।
জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ: বিদ্যুতের নানাবিধ ব্যবহারের কারণে আধুনিক জীবন পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও সহনশীল। বর্তমানে জ্বালানি হিসেবেও বিদ্যুতের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। আধুনিক সমাজে এখন কাঠ, তেল ও গ্যাসের পাশাপাশি বিদ্যুতও ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন কাজের জ্বালানি হিসেবে। মানুষ এখন বিদ্যুতের সাহায্যে হিটার ও কুকারে রান্না করে। বিভিন্ন যানবাহনে এখন তেল ও গ্যাসের পরিবর্তে বিদ্যুতকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি চালানো হচ্ছে বিদ্যুতের সাহায্যে। এভাবে বিদ্যুৎ পৃথিবীর জ্বালানি সম্ভাবনা সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বিদ্যুৎ: আধুনিক যুগকে বলা হয়ে থাকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগ। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার পেছনেও রয়েছে বিদ্যুতের বিশ্বস্ত হাত। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার কম্পিউটারের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ। সব ধরণের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য দরকার বিদ্যুৎ। মহাকাশ অভিযান ও মহাকাশ বিজয়ের সাফল্যের মূলেও বিদ্যুতের অবদান রয়েছে। নির্ভুল হিসাব, দিকনির্ণয়, মহাকাশের ছবি পৃথিবীতে প্রেরণ ইত্যাদি কাজের জন্য ব্যবহার করা হয় নানা ধরণের প্রযুক্তি। সেই প্রযুক্তি আবার বিদ্যুৎ ছাড়া চলতেই পারে না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে বিদ্যুতকে সর্বদা সাথে নিয়ে। বিদ্যুতকে বাদ দিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব না। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ সম্পূর্ণভাবে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি নির্ভর।
উপসংহার: আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের পদচারণা রয়েছে। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে বাড়ছে বিদ্যুতের ব্যবহার। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, শিল্প-কারখানার বিকাশ, কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়নে বিদ্যুতের অবদান অনস্বীকার্য। বর্তমান সভ্যতায় বিদ্যুতের বিকল্প নেই। মহামূল্যবান বিদ্যুৎ শক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বর্তমান সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে আরো উন্নত অবস্থানের দিকে।
No comments