170. সময়ের মূল্য
ভূমিকা: সময় মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। পৃথিবীতে কর্ম অনন্ত, কিন্তু মানবজীবন সংকীর্ণ। মহাকালের অন্তহীন সময়ের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ এই মানবজীবন। কিন্তু জীবনের পরিসরের তুলনায় মানুষের জন্য নির্ধারিত কর্ম অনেক বেশি। ক্ষুদ্র জীবনের স্বল্প পরিসরে মানুষকে অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। ক্ষুদ্র এই জীবনের এক মুহূর্ত সময় হেলা-ফেলায় নষ্ট করলে অনেকখানি পিছিয়ে পড়তে হয়। তাই মানব জীবনকে
সার্থক ও সুন্দর করতে হলে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে মূল্যবান মনে করতে হবে এবং যথাযথ কাজে সময় ব্যয় করতে হবে।
সময়ের মূল্য: সময় অমূল্য সম্পদ। পার্থিব জীবনের ধন-সম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেলে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে হারানো সম্পদ পুনরায় অর্জন করা যায়, স্বাস্থ্য নষ্ট হলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা ফিরে পাওয়া যায়। কিন্তু যে সময় একবার চলে যায়, কোনো কিছুর বিনিময়ে তা আর ফিরে আসে না। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে-‘Time and tide wait for none’। নদীর বয়ে যাওয়া স্রোতকে যেমন চাইলেও আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি অতিবাহিত সময়কেও ফেরত আনা যায় না। মানুষ শত চেষ্টা করলেও অতীতের দিনগুলি ফিরিয়ে আনতে পারে না। আর একারণেই জাগতিক কোনো মূল্যমান দ্বারা সময়কে বিচার করা যায় না। রবার্ট ব্রাউনিং যথার্থই বলেছেন- ‘একটা দিন চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে একটা দিন ঝরে যাওয়া।’ আর ঝরে যাওয়া দিনটিকে কোনো কিছুই বিনিময়েই পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব নয়। ফলে এক মুহূর্ত সময় অপচয় করা মানে জীবনের একটা অংশের অপচয় করা। আর এই অপচয়ের পরিণাম ভয়াবহ।
সময়ানুবর্তিতা: সময়ের কাজ সময়ে করাই হলো সময়ানুবর্তিতা। সময়ানুবর্তিতা মানব চরিত্রের অন্যতম মহৎ গুণ যা মানুষকে সফলতার দ্বারে পৌঁছে দেয়। জগতে প্রতিটি কাজের জন্য উপযুক্ত সময় নির্ধারণ করা থাকে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র বাইবেলে ঘোষিত হয়েছে, ‘এই পৃথিবীতে প্রত্যেক কাজের একটা উদ্দেশ্য, একটাকাল ও একটা সময় আছে।’ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করাই সময়ের সদ্ব্যবহারকারী ব্যক্তির লক্ষণ। আর যে ব্যক্তি সময়ানুবর্তি, তার জীবনে সাফল্য অবশ্যম্ভাবী। স্বল্প পরিসরে আবদ্ধ মানবজীবনকে কালোত্তীর্ণ করে তোলার প্রধান শর্ত হলো সময়ের সদ্ব্যবহার করা। বিনা কারণে সময় অপচয় করলে পরবর্তী জীবনে তার মাশুল দিতে হয়। তাই ফকির লালন শাহ গেয়ে গেছেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না।’ তাই জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের প্রধান শর্ত সময়ানুবর্তিতা জীবনের স্বল্প সময়কে কাজে লাগিয়ে কোনো মহৎ কাজ সম্পাদন করার মধ্যেই ব্যক্তি জীবনের সার্থকতা ফুটে ওঠে। মানবজীবনকে স্বার্থক করতে প্রত্যেকের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত-‘Work while you work, play while you play, And that is the way to be
happy and gay.’
সময়ের সদ্ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা: জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। যারা এই মূল্যবান সময়কে কাজে লাগাতে পারে তারাই স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান করে নিতে সক্ষম। প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর কীর্তি স্থাপন করার মধ্যেই মানব জীবনের সার্থকতা নিহিত। সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে না পারলে জীবনে ধ্বংস অনিবার্য। এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে যে, সময়ের অপব্যবহার করার কারণে অনেক প্রতিভাসম্পন্ন লোকও ধ্বংসের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে। পার্থিব জীবনের সব থেকে বড় সম্পদ এই সময়। আর তাই বলা হয়ে থাকে- 'Time is money’ সময়ের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবনে সাফল্য আসে, আবার এই সময়ের অপব্যবহারের কারণে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
ছাত্রজীবনে সময়ের সদ্ব্যবহার: ছাত্রজীবন হলো মানবজীবন গঠনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তাই ছাত্রজীবনে সময়ের সদ্ব্যবহারের অনুশীলন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রজীবনের প্রতিটি মুহূর্তই অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা ছাত্রজীবনে যারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তারাই পরবর্তীতে কর্মজীবনে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারে। সময়ের অপব্যবহারকারী অলস ছাত্ররা কেবল পরীক্ষাতেই অকৃতকার্য হয় না বরং জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাদেরকে ব্যর্থতার গ্লানি বহন করতে হয়। ছাত্রজীবনে যারা কঠোর সময়ানুবর্তিতার অনুশীলন করে তাদের জীবনে সাফল্য অবধারিত। তাই ছাত্রজীবনই হলো সময়ানুবর্তিতা অনুশীলনের উপযুক্ত সময়। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা প্রত্যেকেই ছাত্রজীবন থেকেই কঠোর সময়ানুবর্তিতার অনুশীলন করে গেছেন। আর এরই ফলস্বরূপ তাঁরা আজ অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে সময়নিষ্ঠার তাৎপর্য: সময়ানুবর্তিতা কেবলমাত্র ব্যক্তি জীবনেই সাফল্য বয়ে আনে না, একই সঙ্গে জাতীয় জীবনেও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির মূলশর্ত সময়ের সদ্ব্যবহার করা। আর যে জাতির প্রত্যেক নাগরিক সময়ানুবর্তী, সে জাতির সাফল্য অবধারিত। বিশ্বের সকল কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক-এরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মে সময়ানুবর্তী ছিলেন। যার ফলে তারা ব্যক্তিজীবনে সাফল্য তো পেয়েছেনই, সেই সাথে জাতিরও মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তাঁদের হাত ধরে জাতিও সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। কেবলমাত্র সময়ানুবর্তিতার বলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত দেশ জাপান বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।
সময়ের অপব্যবহারের পরিণাম: সময়ের অপব্যবহারকারী ব্যক্তির জীবনে ধ্বংস অনিবার্য। সময়ের অপব্যবহার করে কখনোই জীবনের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। সময়ের অপচয়ে কেবল ব্যক্তি একা নয় বরং গোটা সমাজ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সময়ের অপব্যবহারকারী ব্যক্তি অচিরেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। কথায় বলে- ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।’ অর্থাৎ যে কাজটি নির্ধারিত সময়ে করলে একবারেই সুষ্ঠুভাবে করা যেত, সেটিই সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে করতে গেলে দশবারেও সম্পন্ন করা যায় না। আর এর ফলে সময়ের অপব্যবহারকারী ব্যক্তি কেবল পশ্চাতেই পড়ে থাকে। এই পশ্চাপদতা তাকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দিকে। ওয়াটার-লু’র যুদ্ধে নেপোলিয়ানের কোনো এক সেনাপতি নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট পরে হাজির হয়েছিলেন বলে ঐ যুদ্ধে নেপোলিয়ানকে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। সময়ের মূল্য যারা বোঝে না তাদের জন্য হতাশা ব্যর্থতার গ্লানি অবশ্যম্ভাবী।
সময়কে কাজে লাগানোর উপায়: একদিনের চেষ্টায় কোনো মানুষ সময়ানুবর্তিতার গুণটি আয়ত্ত করতে পারে না। তাই সব থেকে ভালো উপায় হচ্ছে পরিবারের মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর মধ্যে এ অভ্যাসটি গড়ে তোলা। জীবনের শুরু থেকেই শিশুকে সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা দিলে পরবর্তীতে সহজেই সে সময়কে কাজে লাগাতে পারবে। শিশুকে বোঝাতে হবে পড়ার সময় পড়া এবং খেলার সময় খেলা। সময়ের কাজ সময়ে না করার ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কেও শিশুকে অবহিত করতে হবে। পারিবারিক এসব শিক্ষা শিশুকে পরবর্তী জীবনে সময়ানুবর্তী হতে সাহায্য করবে। এছাড়াও প্রত্যেক মানুষেরই উচিত প্রতিদিনের সময়কে নির্ধারিত কাজগুলি দ্বারা ভাগ করে নিয়ে প্রতিটি কাজই যথাযথ সময়ে সম্পন্ন করার অভ্যাস করা। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো প্রাত্যহিক রুটিন তৈরি করে নেওয়া। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটা কাজের রুটিন করে নিলে সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে পারা যায়।
সময়নিষ্ঠ ব্যক্তির উদাহরণ: মুহূর্তকেই তাঁরা যথাযথভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে যাদের নাম লেখা রয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই সময়ের মূল্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। জীবনের প্রতিটি কাজে লাগিয়েছেন। আর এই কঠোর সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমেই স্বল্প জীবনকে তাঁরা করে গেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী। বিশ্বের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী-দার্শনিক তাঁদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র জীবনেই কত শত মহৎ সৃষ্টি রেখে গেছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সক্রেটিস, আইনস্টাইন, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, নিউটন, শেক্সপিয়ার প্রমুখ কীর্তিমান ব্যক্তিদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাঁরা কেউই সময় সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না বরং সময়ের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমেই তাঁরা আজও জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছেন।
উপসংহার: সময়ের মূল্য সম্পর্কে সচেতন না হলে জীবনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। যারা সময়কে মূল্যবান মনে করে এবং প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে তারাই সুখী-সমৃদ্ধ জীবন লাভ করে। জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে উপযুক্ত কাজে ব্যয় করতে পারলে ক্ষণস্থায়ী জীবনেও মহৎ সৃষ্টির স্বাক্ষর রেখে যাওয়া সম্ভব। আর এভাবেই মানুষ মরনশীল হওয়া সত্ত্বেও অমরত্ব লাভ করে। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সময়ের মূল্য সম্পর্কে সচেতন থেকে সময়নিষ্ঠ হবার মধ্য দিয়ে জীবনকে স্বার্থক ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা।
No comments