166. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা
ভূমিকা: একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং আদর্শের প্রতিফলন ঘটে প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষা যে দেশে যত সুষ্ঠুভাবে দেয়া হয় সে দেশ তত বেশি উন্নত। প্রাথমিক শিক্ষা মান সম্পন্ন না হলে তা দেশের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। আবার দেশের সকল নাগরিকের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত না করলে একটি দেশ কখনই উন্নতি করতে পারে না। এই বিষয়ের
গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে।
গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা: শিক্ষা মানুষের মৌলিক চাহিদা। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার মতো শিক্ষাও একজন মানুষের জীবনে আবশ্যক। কিন্তু সবার জন্য ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা উচ্চশিক্ষিত হওয়া আবশ্যক বা বাধ্যতামূলক নয়। বরং প্রতিটি মানুষ ন্যূনতম যে পরিমাণ শিক্ষালাভ করলে মৌলিক সাক্ষরতা অর্জন করতে পারবে এবং প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা পূরণ করতে পারবে, ততটুকু শিক্ষা অর্জন করা আবশ্যক। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তকারী একজন ব্যক্তি এতটুকু যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। তাই প্রাথমিক শিক্ষাকে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিরক্ষরতা দূর করতে প্রথমে প্রয়োজন নিরক্ষরতার উৎসমূল বন্ধ করা। মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা তা নিশ্চিত করতে পারে। ৬ থেকে ১০ বছর বয়সের শিশুরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্ত করতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে সাজানো হয়েছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন-১৯৯০ অনুসারে এই বয়সী শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পটভূমি: মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে প্রাথমিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদের ক, খ ও গ-এই তিনটি উপ-অনুচ্ছেদে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে। সংবিধান অনুসারে সবার জন্য একই ধারার মানসম্পন্ন বুনিয়াদি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৯৭৪ সালের প্রথম জাতীয় শিক্ষা কমিটি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছিল। ২য় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৮১-৮৫) সালে প্রথম সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। এরপর ১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রণীত হয়। এই আইনবলে ১৯৯২ সালে দেশের ৬৮টি থানায় আইনটি চালু করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে আইনটি কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কথা বলা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব: জাতীয় জীবনের সকল সমস্যা সমাধানের এক বড় সহায়ক শক্তি হলো শিক্ষা। নিরক্ষরতা হলো সকল সমস্যা, সংকট ও দুর্দশার মূল উৎস। নিরক্ষরতার অভিশাপে জাতি বারবার হতাশাগ্রস্ত হয়। কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, পরিবার-পরিকল্পনা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রকেই বাধাগ্রস্ত করে নিরক্ষরতা। অন্যদিকে জাতি যদি শিক্ষিত হয়ে উঠে তবে এসব সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব হত।
প্রাথমিক শিক্ষার উপযোগিতা: প্রাথমিক শিক্ষা শুধু একটি শিশুর মানবিক গুণাবলী অর্জনের জন্যই প্রয়োজনীয় নয়। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্যও প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। এটি শুধু মানুষকে সাক্ষরতা এবং ভাষাজ্ঞান ও দক্ষতা শিক্ষা দেয় না, একই সাথে তার বিচার বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়। মাঠে-ময়দানে, কল-কারখানায়, কৃষিতে কর্মদক্ষতা বাড়ায়। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা করে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ব্যক্তির আয় প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এরূপ ব্যক্তি অপেক্ষা ৫২.৬% ভাগ বেশি। অনুরূপভাবে তা মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে ৭.২% ভাগ এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৬.২% ভাগ বেশি। আবার প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ৯২.২৫% ভাগ।
বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে প্রায় দুই যুগ আগে। কিন্তু তারপরও এর সাফল্য কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছায়নি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে এদেশে সাক্ষরতার হার ৫১.৮% ভাগ। অন্যদিকে ২০১৩ সালের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর হিসাব অনুসারে এ হার ৬৫.৫ ভাগ। প্রাথমিক শিক্ষায় শিশু ভর্তি হার ৯৯.৪৭ ভাগ হলেও ঝরে পড়ার হার ২১ ভাগ। যে কারণে এখনও বিপুল সংখ্যক শিশু বিদ্যালয়ের বাইরে রয়ে গেছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করলেও তা সন্তোষজনক নয়।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতাসমূহ: বাংলাদেশ উন্নয়নশীল ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এদেশের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ উপযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। সীমিত সম্পদ, অবকাঠামোগত সমস্যা, দারিদ্র্য ইত্যাদি কারণে প্রাথমিক শিক্ষায় অর্জন যথেষ্ট নয়। সবার জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
-পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে।
- শহরাঞ্চল ও গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষার মান সমান নয়। এ ব্যবধান সমস্যার সৃষ্টি করছে।
- শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়, তার ৪০ ভাগ ৫ম শ্রেণিতে উঠার আগেই চলে যায়।
- শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি যথেষ্ট নয়।
- শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ভারসাম্যহীন। ফলে মানসম্পন্ন শিখন-শিক্ষণ সম্ভব হয় না।
- শিক্ষাদানের জন্য যে সময় বরাদ্দ তা পর্যাপ্ত নয়।
- পরীক্ষা পদ্ধতি আধুনিক নয়।
- শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই।
- বিদ্যালয়ের পরিবেশ শিশু বান্ধব নয়।
এছাড়াও শিক্ষকদের অপর্যাপ্ত বেতন ভাতা ও পদমর্যাদা, লোকবল সমস্যা, পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের অভাব, অভিভাবকদের দারিদ্র্য ও অসচেতনতা, ব্যাপক দুর্নীতি ও ঘুষ ইত্যাদি কারণে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
বর্তমান অবস্থায় করণীয়: বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে ইতোপূর্বে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন কারণে এসব পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে সফল হয়নি। অর্থ সংকট এক্ষেত্রে বড় একটি বাধা। প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক তা হলো-
- শিক্ষার্থীর চাহিদাকে সামনে রেখে পর্যাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ।
- শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যক ভৌত সুযোগ সুবিধা এবং পাঠ্যপুস্তক, বোর্ড, চক, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি নিশ্চিত করা।
- পর্যাপ্ত সংখ্যক উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
- শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় এবং যুগের চাহিদাকে পূরণ করার মতো করে তৈরি করা,
- বিদ্যালয়কে শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক করে তোলা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রাখা। খেলার মাঠ ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করা।
- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং উচ্চতর বেতনস্কেল প্রদান করা।
- বিদ্যালয়ে দপ্তরি ও অফিস সহকারীর পদ সৃষ্টি করা।
- শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের জন্য পিটিআই ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টার সমূহকে আরো কার্যকর করে তোলা।
- ডিজিটাল ক্লাশরুমের ব্যবস্থা করা।
- ঘুষ, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করা।
উপসংহার: বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা কেবল সরকারের একক দায়িত্ব নয়। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় অঙ্গীকার, স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণ এবং ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা। আমরা যদি দেশের স্বার্থে, নিজেদের মঙ্গলের জন্য শিক্ষার একটা শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করতে চাই তবে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যোগ্য নেতৃত্ব, অণুপ্রাণিত জনশক্তি, অনুকূল পরিবেশ, সংশোধনমূলক তদারকি এবং অধিকতর সামাজিক সম্পৃক্ততা-ই সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে পারে, দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
No comments