158. সন্ত্রাস মুক্ত বাংলাদেশ
ভূমিকা: ‘সন্ত্রাস’ অর্থ একটি ভীতিপূর্ণ পরিবেশ যেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, মানুষ সর্বদা ভোগে অস্তিত্বের সংকটে। সন্ত্রাসের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে দেশে চরম অরাজকতা দেখা দেয়। আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় সন্ত্রাসের প্রবল প্রতাপের মুখে। মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাজজীবন হয়ে উঠে অশান্তির আখড়া। বর্তমান বাংলাদেশ সন্ত্রাসের কুটিল জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসের আগ্রাসন থেকে সাংবাদিক,
আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, লেখক, শিক্ষক, শিল্পপতি থেকে শুরু করে নিরীহ সাধারণ জনগণ কেউই বাদ যাচ্ছে না। প্রায়ই গ্রেনেড হামলা, বোমাবাজি, বন্দুক যুদ্ধ, বিনষ্ট করছে অনেক প্রাণ, ধ্বংস করছে দেশের সম্পদ।
আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, লেখক, শিক্ষক, শিল্পপতি থেকে শুরু করে নিরীহ সাধারণ জনগণ কেউই বাদ যাচ্ছে না। প্রায়ই গ্রেনেড হামলা, বোমাবাজি, বন্দুক যুদ্ধ, বিনষ্ট করছে অনেক প্রাণ, ধ্বংস করছে দেশের সম্পদ।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসের চালচিত্র: কিছুকাল আগেও সন্ত্রাস বলতে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি বুঝাত এদেশে। কিন্তু বর্তমানে সন্ত্রাসে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। নানা মুখী সহিংসতা জায়গা করে নিয়েছে এতে। বাংলাদেশের সন্ত্রাসের কিছু চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো-
রাজনৈতিক সন্ত্রাস: রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য দেশের সেবা, দেশের মানুষের সেবা। মানবপ্রেমের মহান ব্রতে উৎসাহী হয়ে রাজনীতিবিদরা রাজনীতির মাঠে নামেন। কিন্তু বর্তমানে এই রাজনীতির মধ্যে ঢুকে গেছে স্বার্থের বিষ। রাজনীতি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কতিপয় মানুষের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে। ক্ষমতা দখলের নেশা রাজনৈতিকদের পাগল করে তুলেছে। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা অন্য দলকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত। আর এ জন্য তারা আশ্রয় নিচ্ছে সন্ত্রাসের। রাজনীতি ও সন্ত্রাস এখন একার্থক হয়ে গেছে। ক্ষমতা দখলের লোভ রাজনৈতিক দলসমূহকে বিবেকশূন্য করে দিয়েছে। নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিকে খুন করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, বোমাবাজি এরকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এতে করে শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে সাথে প্রাণ হারাচ্ছে দেশের অনেক সাধারণ মানুষও।
শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস: সন্ত্রাসের আগ্রাসন থেকে বাদ যায়নি দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোও। এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ বাড়িয়ে তুলছে নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। আগের দিনে ছাত্ররা আন্দোলন করত নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে। কিন্তু এখন আন্দোলন করে রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে। এসব রাজনৈতিক দল কলমের বদলে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে অস্ত্র। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। বিভিন্ন ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ সেশন জটে পড়ে। তাদের জীবনের মূল্যবান সময় অপচয় হয়। তাছাড়াও সন্ত্রাসীরা বোমাবাজি, ভাঙচুর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ বিনষ্ট কর। বিভিন্ন দলের ক্ষমতা দখলের সংঘাতে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়, অনেকে প্রাণও হারায়। সন্ত্রাসের কারণে দেশ হারায় অনেক মেধাবী সন্তান।
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস: বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এখানে বাস করে। এদেশের অধিকাংশ মানুষই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। কিন্তু কিছু ধর্মভিত্তিক সংগঠন তাদের নিজ ধর্মের নিয়ম-নীতি পুরো জাতির উপর চাপাতে সদা তৎপর। তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। একটি মুক্তমনা স্বাধীন জাতির চিন্তা-চেতনাকে বাধাপ্রাপ্ত করে তাদের আবদ্ধ রাখতে চাচ্ছে আদিম অন্ধকার যুগে। এ উদ্দেশ্যে তারা চালাচ্ছে নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। বোমাবাজি, খুন, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন প্রভৃতির মাধ্যমে জনজীবনকে অতিষ্ট করে তুলছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো তাদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ বলে মনে করে। তাদের তথাকথিত জিহাদের ফলে প্রাণ হারাচ্ছে আইনজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবীসহ দেশের সাধারণ অনেক মানুষ।
নারীর প্রতি সহিংসতা: বর্তমান সমাজ সন্ত্রাস ও নানা সহিংসতায় পরিপূর্ণ। আর এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন নারী। এসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহ পরিণতির শিকার হচ্ছে নারী। যৌতুক না পেয়ে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, কিংবা অন্য কোনো শত্রুতার জের ধরে সন্ত্রাসীরা এসিড ছুঁড়ে মারছে নারীদের উপর। বর্তমানে নারীর প্রতি সহিংসতায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে গণধর্ষণ। নানা পারিবারিক শত্রুতার বশবর্তী হয়ে, চাকরির লোভ দেখিয়ে বা প্রেমের নামে প্রতারণা করে সন্ত্রাসীরা নারীদের উপর চালাচ্ছে এই অমানুষিক নির্যাতন।
গুম: বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত সন্ত্রাস ‘গুম’। যা দেশের সীমা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বেই সমালোচিত। গুম হচ্ছে জোরপূর্বক কোনো মানুষকে ধরে নিয়ে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যসাধনে গোপনে আটকে রাখা। বাংলাদেশে অল্প সময়ের মধ্যে এতো বেশি গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে যা বিশ্বের কোনো দেশেই আগে ঘটেনি। পারিবারিক শত্রুতা, রাজনৈতিক মতানৈক্য, মুক্তিপণ লাভ ইত্যাদির উদ্দেশ্যে গুম হওয়ার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে গুম এদেশে এতো প্রকট আার ধারণ করেছে যে এদেশের মানুষ সর্বদা তাদের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে।
সন্ত্রাসের বহুবিদ কারণ: সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বহুবিদ কারণ রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
আইন-কানুনের শিথিলতা: অপরাধী যখন তার কৃতকর্মের শাস্তি না পায় তখন তার সাহস বেড়ে যায় এবং পুনরায় অপরাধ করার অনুপ্রেরণা পায়। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরদর্শিতার অভাবে অনেক সন্ত্রাসী গুরুতর অপরাধ করা সত্ত্বেও পার পেয়ে যায় তাদের প্রাপ্য শাস্তি থেকে। তাছাড়া বাংলাদেশি সন্ত্রাসী চক্রগুলো এতো শক্তিশালী যে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতের নাগালের বাহিরে থেকে যায়। তাছাড়াও আইনের লোকজন নিজেদের নানা সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে এসব সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দেয়। মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে কমিয়ে দেয় সন্ত্রাসীদের শাস্তির মাত্রা। ফলে আইনের ফাঁদ থেকে ছাড়া পেয়ে আসামীরা আবারও লিপ্ত হয় সন্ত্রাসে।
নিম্ন জীবনযাত্রার মান: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক নিম্ন। সাধারণ মানুষেরা তাদের মৌলিক চাহিদা সঠিকভাবে পাচ্ছে না। তাছাড়া এদেশে জনসংখ্যা অনেক বেশি কিন্তু সে অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। দেশের বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রী নিয়ে বের হয়েও অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী কোনো চাকুরী পাচ্ছে না। এই কর্মসংস্থানের অভাব ও জীবনযাত্রার নিম্নমান এদেশের যুব সমাজকে ঠেলে দেয় সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দিকে। একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় বিবেক, মনুষত্ব্য বিসর্জন দিয়ে তারা জড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রাসের জালে। জীবিকা নির্বাহর পথ হিসাবে বেছে নিচ্ছে ডাকাতি, খুন, ছিনতাই প্রভৃতি।
আধিপত্য বিস্তারের আকাক্সক্ষা: আধিপত্য বিস্তারের আকাক্সক্ষা সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ। দেশের শাসন ব্যবস্থার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে সন্ত্রাস। বিরোধী দলকে পরাস্ত করতে গড়ে তোলা হচ্ছে সন্ত্রাসী চক্র। এসব সন্ত্রাসী চক্রের ক্যাডাররা নিজেদের দলের হয়ে বোমা মারছে, গুলি ছুড়ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের উপর।
সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণে করণীয়: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই বাংলাদেশ। যুগেযুগে অনেক মহৎ ব্যক্তির আত্মত্যাগে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায়। কিন্তু কিছু স্বার্থন্নেষী মানুষের কদর্য মানসিকতার ফলে বাংলাদেশ হারাতে বসেছে তার আপন মহিমা। এদেশকে সন্ত্রাসের ছত্রছায়া থেকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ধরে রাখার লোভ পরিত্যাগ করতে হবে। তাদের প্রধান ব্রত হওয়া উচিত মানুষের সেবা। দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে তাদের। দেশের বৃহৎ স্বার্থে নিজেদের ক্ষুদ্র চাহিদা জলাঞ্জলি দিতে পাবার মানসিকতা থাকতে হবে দেশের সব মানুষের। সেই সাথে মানুষের নৈতিক ও মানবিক বোধের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পদ্ধতি আরো জোরদার করতে হবে। তবে শুধু নতুন নতুন আইন তৈরী করলেই হবে না সেসব আইন বাস্তবায়নের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সন্ত্রাস নির্মূলে আইন রক্ষাকারী সদস্যদের ভূমিকা অনেক বেশি। কোনো ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার লোভে প্রভাবিত না হয়ে সন্ত্রাসীদের যোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করলেই কেবল সন্ত্রাস দমন সম্ভব। যোগ্য শাস্তি পেলে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা হ্রাস পাবে। সর্বোপরি দেশের সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রতিরোধই পারে সমাজ থেকে সন্ত্রাসী দূর করতে।
উপসংহার: একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ ও একটি সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন আমাদের সবারই রয়েছে। এই কাঙ্ক্ষিত সমাজ ও দেশ পেতে হলে আমাদের অবশ্যই সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে। আগামী প্রজন্ম সুস্থ সমাজ উপহার দিতে বন্ধ করতে হবে সকল অনিয়ম-অবিচার। শত অন্যায় সহ্য করতে করতে জাতির পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে, এখনই ঘুরে দাঁড়াতে হবে, প্রতিবাদ জানাতে হবে সন্ত্রাসের মত সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে।
No comments