155. বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন
ভূমিকা: গ্রাম-পল্লী প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সৃষ্টিকর্তার অপরূপ নিদর্শন গুলোর একটি। 'God made the village and man made the
town' পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তাই এই কথাটি বেশ জনপ্রিয়। গ্রামীণ জীবন প্রকৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতির স্নিগ্ধ সবুজ, প্রশান্তির ছায়া, কোমল হাওয়া, কাক ডাকা ভোর বা টিনের চালে ঝম্ঝম্ বৃষ্টির শব্দ প্রভৃতি আনন্দময় অনুভূতি ও মুহূর্ত কেবল মাত্র গ্রামীণ
জীবনের সংস্পর্শেই পাওয়া যায়। গ্রামের সারি সারি গাছপালা, আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ, ফসলের ক্ষেত, বসতবাড়ি, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য সবকিছুই ছবির মতো। সব কিছু মিলে গ্রাম-বাংলার জীবনযাত্রা পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এর মতোই অনিন্দ সুন্দর ও স্নেহ-মমতা জড়ানো।
জীবনের সংস্পর্শেই পাওয়া যায়। গ্রামের সারি সারি গাছপালা, আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ, ফসলের ক্ষেত, বসতবাড়ি, পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য সবকিছুই ছবির মতো। সব কিছু মিলে গ্রাম-বাংলার জীবনযাত্রা পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এর মতোই অনিন্দ সুন্দর ও স্নেহ-মমতা জড়ানো।
পল্লী প্রকৃতি: কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার পল্লী প্রকৃতিকে ভালোবেসে মমতা ভরা হৃদেয় রচনা করে গেছেন-
‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার
হেরিনু পল্লী জননী’।
গ্রামাঞ্চলের সাথে বাঙালির নাড়ির সম্পর্ক। পলাশ ডাকা-কোকিল ডাকা আর ধানের ক্ষেতে মৃদু মন্দ হাওয়ার ঢেউ খেলানোর মতো দৃশ্য গ্রাম বাংলার এক চিরাচরিত রূপ। দিগন্ত-জোড়া ফসলের ক্ষেতের মাঝখানে কিছুদূর পর পর দু-একটা বসতবাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। কল্পনার রাজ্যে তখন এই কুঁড়ে ঘর গুলোকেও রাজপ্রাসাদের মতো মনে হয়। দোয়েল, কোকিল, ঘুঘু, পাপিয়া, বৌ-কথা কও প্রভৃতি পাখি গ্রাম্য প্রকৃতিকে সারাবেলা মোহনীয় সঙ্গীতে মাতিয়ে রাখে। ধানের ক্ষেতে অল্প পানিতে বকের এক পায়ে-দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য, মাছরাঙ্গা পাখির পুকুর থেকে মাছ শিকারের ফন্দি দেখা, ঝড়ের দিনে আম কুড়ানোর মতো সুখ কেবলমাত্র গ্রামে এলেই মানুষ পেতে পারে।
পাশ্চাত্য ও বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন: পৃথিবীর সব দেশেই শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের অস্তিত্বও বিরাজমান। তবে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে গ্রাম বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশের গ্রাম তা নয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলো শহর কেন্দ্রীক। শহরকে কেন্দ্র করেই তাদের লোকালয় গড়ে উঠেছে। কিন্তু জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি কাজ, ক্ষেত খামার, পশু চারণ ভূমি, ফলের বাগান, মাছের চাষ প্রভৃতি কাজকর্ম শহর থেকে কিছুটা দূরবর্তী স্থানে সম্পাদন করা হয়। এ ধরণের অঞ্চলকেই তারা গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে এসব কাজকে কেন্দ্র করে সেখানে আমাদের দেশের মতো লোকালয় বা সমাজ গড়ে উঠে না। পাশ্চাত্যের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট উন্নত। যান্ত্রিক সভ্যতার প্রভাবে তাদের গ্রামাঞ্চলগুলোতেও আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে। উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড গুড়া দুধ উৎপাদনে শ্রেষ্ঠ। এসব উন্নত দেশের গ্রামগুলোতে উৎপাদিত ফসল ও গোবাদি পশুর দুধ বা মাংস ইত্যাদি উপাদান সংরক্ষণ ও যথাসময়ে নির্ধারিত স্থানে সরবরাহ করার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থায়ও কোনো অসুবিধা নেই। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন পাশ্চাত্যের এই উন্নত দেশগুলোর তুলনায় নিম্নমানের। গ্রামকে কেন্দ্র করেই আমাদের সমাজ গড়ে উঠেছে। শতকরা পঁচাশি জন লোক গ্রামে বাস করে। আমাদের দেশের অনেক গ্রাম এখনও বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ হওয়ার কারণে গ্রামের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে সারাদেশের মানুষ।
অতীতের গ্রামীণ জীবনযাত্রা: অতীতে নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যেত। এ সময় বাংলার গ্রামবাসীদের গোলাভরা ধান ছিল, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ ছিল। বর্তমান সময়ের ন্যায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বাংলার গ্রামীণ সমাজকে স্পর্শ করতে পারেনি। অতীতে আয়োজন করে ঘরে বসেই চলত পুঁথি পাঠ। যাত্রা, পাঁচালী ইত্যাদি গ্রামীণ জীবনের আকাশ বাতাসকে মুখরিত করে রাখতো। তখন গ্রাম্য লোকজন পল্লী সাহিত্য ও সংস্কৃতির যথাযথ চর্চা করার সুযোগ পেত। লেখাপড়া করার তেমন সুযোগ না থাকলেও সেসময় গ্রামের মানুষদের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাসটা ছিল গভীর ও সুদৃঢ়। অতীতে গ্রাম্য জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধটাও ছিল প্রগাঢ়।
গ্রামীণ জীবনের অসুবিধাসমূহ: বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে এর বিপরীতমুখী প্রভাব দেশের গ্রামাঞ্চলকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গ্রামীণ মানুষের মধ্যে সীমাহীন অভাব অনটন দেখা দিয়েছে, ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে তারা দূরে সরে এসেছে, নিজেদেরকে কলহ বিবাদে জড়িয়ে নিচ্ছে, কৃষক প্রতিনিয়ত তার ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন নতুন বিভিন্ন জটিল রোগ ব্যাধি দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় উন্নত ও পর্যাপ্ত পরিমাণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই আমাদের গ্রামাঞ্চলগুলোতে। গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থাও তেমন মান সম্মত নয়। গ্রামের রাস্তাঘাটগুলো শহরের তুলনায় উন্নত বা পাকা নয়। যার ফলে গ্রাম থেকে শহরে মালামাল পরিবহন বা পথচারীদের যাতায়াতে অসুবিধা হয়।
গ্রামীণ জীবনের দূরবস্থার কারণ: বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের দূরবস্থার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার প্রভাবে গ্রামের মানুষগুলো শহরমুখী হতে শুরু করেছে। পোশাক শিল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে গ্রামের সব বয়সী নারী-পুরুষ চাষাবাদ ও খেত খামার ফেলে তুলনামূলক সস্তা দামে নিজেদের শ্রমকে বিক্রি করে দিচ্ছে। বড় বড় শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে কুটির শিল্পের সমাদর কমে যাচ্ছে। ফলে কর্মসংস্থানের খোঁজে, নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক অভাব পূরণে ও উচ্ছাশার কারণে মানুষ গ্রামীণ জীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরকারি বাজেটে গ্রামাঞ্চলের জন্য খুব কমই বরাদ্দ থাকে।
গ্রামীণ জীবনের উন্নতির উপায়: কৃষি প্রধান দেশের কৃষিকাজই অর্থনীতির মূল ভিত্তি। আর আমাদের দেশে যারা গ্রামে বাস করে, তাদের বেশির ভাগই কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের ভাগ্যের উন্নতি না ঘটলে তারা তাদের কাজে উৎসাহবোধ করবে না। সুতরাং কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্য পায় সে জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করতে হবে এলক্ষ্যে। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে ঘরে বসেই কৃষকগণ ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্যাদি ও নির্দেশনা পেতে পারবে। কৃষকদেরকে মধ্যসত্ত্বভোগীদের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। তাছাড়া টিভিতে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে তাদেরকে সচেতন করা যেতে পারে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করে গ্রামের মানুষগুলোকে দক্ষ মানব সম্পদে রূপান্তর করা যাবে। প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষার স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে গ্রামের মানুষকে আত্মনির্ভরশীল জনগোষ্ঠিতে পরিণত করা যাবে। গ্রামের মানুষগুলোর কাছে আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দিতে এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে উন্নত মানের চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। আর্সেনিকের কবল থেকে রক্ষা ও গ্রামের মানুষের মাঝে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে টিউবওয়েল বসানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গ্রামে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। গ্রামবাসী যেন স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার ব্যবহার করে সেজন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
বাঙালি ঐতিহ্যের মাঝে গ্রামীণ সমাজ: বাঙালি ঐতিহ্য ও গ্রামীণ সমাজ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলার ঐতিহ্যবাহী জারি গান, সারিগান, গাজীর গান, পালা গান, ভাটিয়ালী গান, যাত্রা গান বাঙালির সূচনা লগ্ন থেকে গ্রামীণ সমাজ তার বুকে ধারণ করে আসছে। এছাড়া হা ডু ডু, নৌকাবাইচ প্রভৃতি ও বাংলার ঐতিহ্যকে বহন করে। এসব ঐতিহ্যবাহী গান ও খেলা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভান্ডরে মনি-মুক্তার সাথে তুলনীয়। কবির সেই বিখ্যাত কবিতা আজও চির অমলিন-
‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন’।
উপসংহার: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরপুর এক অপরূপ লীলাভূমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সবুজ শ্যামলীমায় শোভিত আমাদের গ্রামাঞ্চলগুলো। আমাদের দেশের চালিকা শক্তির অন্যতম উৎস গ্রামাঞ্চল। সুতরাং এই গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বজায় রাখাকে অবজ্ঞা করলে চলবে না। গ্রামে যে প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐশ্বর্য রয়েছে সেগুলোকে সঠিকভাব কাজে লাগাতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে চাষাবাদ, কতিপয় উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ, গ্রাম্য জনগণের একতাবদ্ধতা ও সরকারের সহযোগিতামূলক মনোভাবই পারে গ্রামীণ জীবনের হারানো হাসি আনন্দ ও লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে দিতে।
No comments