143. বিশ্ব ইজতেমা
ভূমিকাঃ সব ভেদাভেদের প্রাচীর ভেঙে বিশ্ব মুসলিমের সম্প্রীতির এক মিলনমেলা বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা সাধারণত তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ যা রাজধানী ঢাকার ২২ কি.মি উত্তরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাবলিগ জামাতের এই সমাবেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মুসলিম সমাবেশ। এতে অংশগ্রহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ। বিশ্ব ইজতেমা এক দিকে যেমন মানুষের মধ্যে ব্যাপক ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য তৈরি করে অন্যদিকে মুসলমানদের ধর্মীয় ভিতকে মজবুত করে।
বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাসঃ আরবি ইজতেমা অর্থ সম্মিলিত সভা বা সমাবেশ। প্রথম দিকে ঢাকার কাকরাইল মসজিদ ও সংলগ্ন রমনা উদ্যানের একাংশে অনুষ্ঠিত হত এই মহাসমাবেশ। ইজতেমার ইতিহাস থেকে জানা
যায়, বাংলাদেশে ইজতেমা হওয়ার প্রায় তিন চার যুগ আগে ভারতের সাহারানপুরে তাবলিগ জামাতের কাজের গোড়াপত্তন ঘটে। বর্তমান ধারার এই তাবলিগি কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। ১৯২০ সালে তিনি তাবলিগি দাওয়াত শুরু করেন। তিনি এ কার্যক্রমকে তখন বলতেন ‘ইসালে নফস’ বা আত্মশুদ্ধির প্রাথমিক পাঠ। প্রথম দিকে তার মতাদর্শ তেমন একটা সাড়া না জাগালেও পরবর্তীতে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়; যার ধারাবাহিকতা এখনও ক্রমবর্ধমান।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইজতেমাঃ বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা হয়। ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পগার গ্রামে খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেওয়ায় এটি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিত লাভ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদীর উত্তর পূর্ব তীর সংলগ্ন ১৬০ একরের বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দরসহ বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি ইজতেমায় অংশ নেয়।
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজকঃ মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগের প্রবর্তনের সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মেলন বা ইজতেমার আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আব্দুল আজিজ (রহ.)। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়। পুরো সমাবেশের আয়োজন করে থাকেন অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক। বাংলাদেশ সরকারও বিশ্ব ইজতেমা সফল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি ও কার্যক্রমঃ বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী। কিন্তু বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি তিন-চার মাস আগ থেকেই শুরু হয়ে যায়। বাঁশের খুঁটির উপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে উন্মুক্ত মাঠ সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। বিদেশি মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ওপরে খুঁটি নম্বার দিয়ে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীগণ খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের অবস্থান সনাক্ত করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা ওয়ারী মাঠের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে।
সাধারণত প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার আম বয়ান ও বাদ জুমা থেকে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বর্তমানে বিশ্ব ইজতেমা প্রতিবছর দুই বার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইজতেমা কর্তৃপক্ষ। এরই ধারবাহিকতায় ২০১১ সাল থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় এবং তিন দিন করে আলাদা সময়ে মোট ছয় দিনে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ আম বয়ান বা উন্মুক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হয় এবং আখেরি মোনাজাত বা সমাপনী প্রার্থনার মাধ্যমে শেষ হয়।
ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টিতে বিশ্ব ইজতেমাঃ বিশ্ব ইজতেমা মানুষের মধ্যে ব্যাপক ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্য সৃষ্টি করে এবং আধ্যাত্মিক ভাবনার উন্মেষ ঘটায়। বিশ্ব ইজতেমা মূলত তাবলিগ জামাতের মহাসমাবেশ হলেও সকল মুসলমান এখানে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।
মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব ইজতেমাঃ মুসলিম ঐক্য সৃষ্টিতে বিশ্ব ইজতেমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় সারা বিশ্বের মুসলমান জামায়েত হন বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে। বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর দরবারে হাত তোলেন। এটা যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তেমনি মুসলিম ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ইসলামী সমাজ গঠনে বিশ্ব ইজতেমাঃ ইসলামী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও বিশ্ব ইজতেমার একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এটি ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ায়। পৃথিবীতে মানবতার কল্যাণে মুসলমানদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে তারই মহড়া স্থাপিত হয় বিশ্ব ইজতেমায়। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে দ্বীন-ইসলামের প্রচার করে ইসলামী সমাজ গঠনে বিশ্ব ইজতেমা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্ব ইজতেমাঃ পৃথিবীর যেসব দেশে মুসলমানদের বসবাস রয়েছে তার প্রায় সব দেশ থেকেই মুসলমানরা বিশ্ব ইজতেমায় শরিক হন। সবচেয়ে বেশি মুসল্লি আসে পাকিস্তান থেকে। এছাড়াও ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, সৌদিআরব, ওমান, কাতার, সুদান, সেনেগাল, আলবেনিয়া, তুরস্ক, মিয়ানমার, পর্তুগাল, ব্রাজিল, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিগণ জামায়েত হন বিশ্ব ইজতেমায়। তাই বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক ও ধর্মীয় ইমেজ গড়ে উঠেছে এবং তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোট কথা দেশের পরিচিতি সম্প্রসারণেও ইজতেমার একটি ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। ইজতেমার খবরা-খবর বিশেষ করে আখেরি মোনাজাতের অনুষ্ঠানটি গণমাধ্যমগুলোকে গুরুত্ব সহকারে প্রচার করতে দেখা যায়।
আখেরি মোনাজাতঃ বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাতের জন্য যেভাবে মানুষ টঙ্গীর ইজতেমার ময়দানের দিকে ছোটে তা সত্যিই প্রবল ধর্ম চেতনার বহিঃপ্রকাশ। আখেরি মোনাজাতের দিন ইজতেমা ময়দান ছাপিয়ে টঙ্গীর পথ-অলিগলি সবখানে, এমনকি হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত লোকে-লোকারণ্য হয়ে পড়ে। যে যেখানে পারেন দুহাত তুলে জায়নামায কিংবা খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে পড়েন। আল্লাহর দরবারে ‘আমীন’, ‘আমীন’ বলে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বাংলাদেশ সরকারের সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, বিরোধী দলীয় নেতাসহ অন্যান্য নেতা-নেত্রীরা আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। ভ্রাতৃত্ববোধ ও সমগ্র মানব জাতির চিরকল্যাণ আর মুসলিম উম্মার শান্তি ও উন্নয়ন কামনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটে।
উপসংহারঃ বাংলাদেশের ঢাকার টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমা বিশ্বের মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসম্মেলন। ইজতেমার সময় টঙ্গীর তুরাগ যেন মিশে যায় গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, নীল, দোজলা, ফোরাত, মিমিসিপি, আমাজনের সঙ্গে। বিশ্ব ইজতেমা একাত্ম করে মুসলিম বিশ্বকে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী চর্চা ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে বিশ্ব ইজতেমা অপরিসীম ভূমিকা পালন করছে।
No comments