102. মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব
ভূমিকা: একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান গুলির মধ্যে মানব সম্পদ অন্যতম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য দক্ষ মানব সম্পদের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মানুষের জন্যই উন্নয়ন এবং মানুষই উন্নয়ন করে। তাই অর্থ সম্পদ ও ভৌত সম্পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও যদি মানব সম্পদের অভাব থাকে তবে সেক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রক্রিয়া মন্থর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য মানব সম্পদ উন্নয়ন আবশ্যক।
মানব সম্পদ: মানব সম্পদ একটি অর্থনৈতিক প্রত্যয়। অর্থনীতিবিদগণ তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে
একে ব্যাখ্যা করেছেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল জে মায়ার, মানব সম্পদকে একটি দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন যে, অন্যান্য সম্পদের মতো মানুষও সম্পদ। তবে মানব শক্তি তখনই মানব সম্পদে পরিণত হবে, যখন তা সুপরিকল্পিত উপায়ে পরিচালিত হবে।
মানুষ কখন মানব সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে: সাধারণ মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে তবেই মানব সম্পদে পরিণত হতে পারে। মানব সম্পদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো সুস্বাস্থ্য। মানুষ যখন সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে তখন সে সম্পদে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তাছাড়া-
-মানুষ যখন কোনো উৎপাদনমূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকে বা যুক্ত থাকার যোগ্যতা রাখে তখন তাকে মানব সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
-মানুষের মানসিক ক্ষমতা এবং সুস্থতা মানব সম্পদের অন্যতম উপাদান।
-মানুষকে মানব সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সাক্ষরতা।
মানব সম্পদ উন্নয়ন: মানব সম্পদ উন্নয়ন হলো জনসম্পদের এমন এক গুণগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা উৎপাদন ও দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে পারে। এসব জনশক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জোরালো ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় এবং মানবীয় শক্তি সামর্থ্যরে সর্বোত্তম বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়ে উঠে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে মানব সম্পদ উন্নয়ন হলো ব্যক্তিকে কর্মে নিযুক্ত করার সম্ভাবনা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া। অর্থাৎ মানব সম্পদ উন্নয়ন হলো এমন এক প্রক্রিয়া বা প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে কোনো সমাজের সকল মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
মানব সম্পদ উন্নয়নের গুরুত্ব: উন্নয়ন মূলত মানুষ কেন্দ্রিক। এজন্য পল্লী উন্নয়ন, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, কৃষি উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে মানুষকেই। এসব উন্নয়ন ঘটাবেও মানুষ। অতএব একটি দেশের বস্তুগত সম্পদ এবং সম্ভাবনা যতই থাকুক না কেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এ সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে না পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। আর মানুষ তা করতে পারবে তখনই যখন তারা মানব সম্পদে পরিণত হবে। তাই দেশের স্বার্থে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে।
মানব সম্পদকে উন্নয়নের ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এই সম্পদকে একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সীমিত আয়তনের জাপান, হংকং, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হলো তাদের দক্ষ মানব সম্পদ। তাই উন্নয়নের স্বার্থে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
মানব সম্পদ উন্নয়নের উপায়: মানব সম্পদে পরিণত হতে হলে মানুষকে কতিপয় গুণাবলীর অধিকারী হতে হয়। আর এই গুণাবলী অর্জনের উপায় হলো-
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা: প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত কাঠামোবদ্ধ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানব সম্পদে পরিণত হয় মানুষ।
কর্মকালীন প্রশিক্ষণ: কর্মকালীন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ মানুষের দক্ষতা বাড়ায়।
আত্ম উন্নয়ন: জ্ঞান, দক্ষতা ও সামর্থ্যরে উন্নয়ন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
স্বাস্থ্য উন্নয়ন: উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবা মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ায়।
পুষ্টি উন্নয়ন: পুষ্টি মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ফলে মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে পারে।
মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব: মানব সম্পদ উন্নয়ন হলো সব ধরণের উন্নয়নের কেন্দ্র। আর শিক্ষা হলো মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রধান উপায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা মানুষের দক্ষতাকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং সুনির্বাচিত উচ্চশিক্ষা দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক। কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ এর উদাহরণ। এসব দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা: মানুষকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মানব সম্পদ প্রসঙ্গটি প্রধান হিসেবে দেখা দেয়। আর দেশের জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নে যেভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে তার মধ্যে প্রধান হলো-
শিক্ষা পরিবর্তনের সূচনা করে: শিক্ষা আত্মসচেতনতা বাড়িয়ে দেয়। মানুষের মাঝে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করে। মানুষকে তাদের অভ্যাস, রীতিনীতি এবং সামাজিক অবস্থা ও ব্যবস্থাপনা জানতে সহায়তা করে শিক্ষা।
জ্ঞানার্জনের পথ প্রশস্ত করে: নিরক্ষরদের জ্ঞানার্জনের সুযোগ কম। কিন্তু সে সাক্ষর হলে নিজ উদ্যোগে প্রয়োজনমতো বইপত্র এবং সংবাদপত্র পড়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে। নিজের বিবেক বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে সে সমাজ ও পরিবারের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
সমাজ সচেতনতা ও ঐক্যবোধ জাগ্রত করে: শিক্ষা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উদার করতে সহায়তা করে। শিক্ষা মানুষের চেতনা ও বিবেকের পরিবর্তন ঘটায়। ফলে শিক্ষিত ব্যক্তি সমাজের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ভাবতে শেখে, সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে শেখে।
নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ববোধের উন্মেষ ঘটায়: শিক্ষা লাভের ফলে ব্যক্তি নাগরিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে জানতে পারে। নাগরিক দায়িত্ববোধ উপলব্ধি করতে পারে। নিজের ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে: একজন সাক্ষর শ্রমিক নিরক্ষর শ্রমিকের চেয়ে বেশি দক্ষ। আবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সম্পন্নকারী কর্মীরা যারা তা সম্পন্ন করেনি তার চেয়ে বেশি দক্ষতা সম্পন্ন। কেননা শিক্ষিত ব্যক্তি নিরক্ষর বা কমশিক্ষিত ব্যক্তির চেয়ে বেশি সচেতন। তার চিন্তা, বিচার বিশ্লেষণ, আত্মমূল্যায়ন ও সংশোধন ক্ষমতা অনেক বেশি। তাছাড়াও নিজ পেশা সম্পর্কে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি যে জ্ঞান অর্জন করতে পারে পড়াশুনার মাধ্যমে তা তার দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়তা করে: সর্বজনীন শিক্ষা সুষম সমাজ গঠনে সহায়তা করে। সমাজের অবহেলিত মানুষও শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নিজের জীবনমান এবং আয় বাড়াতে সমর্থ হয়। এটি সমাজের বৈষম্য দূর করে।
শিক্ষা জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটায়: শিক্ষা মানুষকে আত্মসচেতন করে তোলে। স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর জীবনযাপনের অনুপ্রেরণা যোগায়। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে মানুষ পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পারে। ফলে সে নিজের মূল্যায়ন করতে পারে এবং নিজের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সচেষ্ট হয়।
মানব সম্পদ উন্নয়নের উপযোগী শিক্ষা: সব ধরণের শিক্ষাই যে মানব সম্পদ উন্নয়নের উপযোগী, তা কখনই নয়। মৌলিক শিক্ষা পেশা পরিবর্তনের যথেষ্ট সহায়তা করে। কিন্তু প্রচলিত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মানব সম্পদ উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে না। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা দেশ ও সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মীর যোগান দিতে পারে না। অথচ বিপুল সংখ্যক মানুষ বেকার থাকলেও উপযুক্ত লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ দক্ষতা সম্পন্ন যোগ্য কর্মী তৈরির উপযোগী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং পর্যাপ্ত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ।
বাংলাদেশের মানব সম্পদ উন্নয়নে করণীয়: বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করতে পারলে তা দেশ ও জাতির উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারবে। উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা তা করতে পারছে না। এজন্য করণীয় হলো-
- প্রতিটি শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। উপযুক্ত শিক্ষক ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
- মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষ কর্মী তৈরির মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। এ স্তরে কর্মমুখী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
- দেশের চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত বিষয়ে দক্ষ-বিশেষজ্ঞ শ্রেণি তৈরির উপযোগী উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা। অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিয়ে বাস্তব চাহিদাসম্পন্ন বিষয়ের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা।
- নিরক্ষর জনসাধারণের জন্য গণশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যাতে তাদের সাক্ষরতা অর্জিত হয়। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এসব জনগণের দক্ষতা বাড়বে। এটি দেশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
উপসংহার: বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশই কেবল প্রাকৃতিক সম্পদের দ্বারা সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে না। মানব সম্পদের গুরুত্বও অপরিসীম। মানব সম্পদ উন্নয়ন হলো দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। আর মানব সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক এবং যুগোপযোগী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করতে পারেনি। তাই মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।
No comments