80. সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম

ভূমিকাঃ বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। যুগের উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে বসবাস করার পাশাপাশি প্রতিনিয়তই একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। সেই কাজটি অত্যন্ত সহজতর করার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমঃ যোগাযোগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একটা সময় কবুতর কিংবা হাতের লেখা চিঠির উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সময়ের পথ-পরিক্রমায় বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে মানুষ সহজতর মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে। এই যোগাযোগের এমনই একটি মাধ্যম হচ্ছে Social Networking site বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এটি ব্যবহার করে উন্নত দেশগুলো তাদের যোগাযোগকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর করে ফেলেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও পিছিয়ে নেই। নিম্নে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
ফেসবুকঃ ফেসবুক (Facebook)  বিশ্ব-সামাজিক আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট। ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুকই বৃহত্তম। এর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন মার্ক জাকারবার্গ। তার হাত ধরেই ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ফেসবুক যাত্রা শুরু করেছিল। এটি ব্যবহারকারীগণ বন্ধু সংযোজন, বার্তা প্রেরণ এবং তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাবলী হালনাগাদ আদান-প্রদান করতে পারেন। সেই সাথে একজন ব্যবহারকারী শহর, কর্মস্থল, বিদ্যালয় এবং অঞ্চলভিত্তিক নেটওয়ার্কেও যুক্ত হতে পারেন
ব্লগঃ ব্লগ (Blog) শব্দটি ওয়েবলগ থেকে এসেছে। যার অর্থ আলোচনা বা তথ্য সম্পর্কিত সাইট। বর্তমান বিশ্বে তথ্যের চাহিদা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। বই বা লাইব্রেরিতে হাজার হাজার বই ঘেটে প্রয়োজনীয় তথ্য যোগাড় করা কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আর এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য অনলাইনভিত্তিক ওয়েব লগ এর যাত্রা শুরু হয় যা পরবর্তীতে ব্লগ হিসেবে প্রচলিত হয়। যিনি ব্লগে পোস্ট করেন তাকে ব্লগার বলা হয়। মানুষের তথ্য চাহিদা পূরণের জন্য ব্লগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিনিয়তই মানুষ ব্লগের কল্যাণে চাহিদার উপরে ভিত্তি করে তথ্য অনুসন্ধান করছে এমনকি গবেষণাসহ বিভিন্ন জরিপ পরিচালনা করছে। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার নতুন ব্লগের জন্ম হচ্ছে। সেই সাথে তৈরি হচ্ছে অনলাইনে লক্ষ লক্ষ নিবন্ধ
টুইটারঃ বর্তমান বিশ্বে যতগুলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে টুইটার (Twitter) অন্যতম। টুইটার সামাজিক আন্তঃযোগাযোগের ব্যবস্থা এবং মাইক্রোব্লগিংয়ের একটি ওয়েবসাইট, যেখানে ব্যবহারকারীরা সর্বোচ্চ ১৪০ শব্দের বার্তা আদান-প্রদান প্রকাশ করতে পারেন। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে টুইটারের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, হলিউড, বলিউড থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ টুইটার ব্যবহার করে থাকেন
গুগল প্লাসঃ গুগুল প্লাস (Google+) হচ্ছে সার্চ ইঞ্জিন গুগলের সামাজিক যোগাযোগের একটি সাইট। এটি চালু হওয়ার পর থেকেই মূলত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। গুগল প্লাস জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুকের মতো নয় বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে ফেসবুকের সাথে কিছুটা মিল থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারকারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই ধরণের উদ্যোগ
উইকিপিডিয়াঃ উইকপিডিয়া (Wikipaedia) তথ্য, সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সৃষ্ট ওয়েবভিত্তিক, বহুভাষিক, মুক্ত বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বহুল প্রচলিত অনলাইন তথ্যকোষের প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস এবং ল্যারি স্যাংগার। ২০০১ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে পথচলা শুরু হয় ওয়েবসাইটটির। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে
ইউটিউবঃ ইউটিউব (Youtube) একটি ভিডিও আদান-প্রদান করার ওয়েবসাইট। এটি বর্তমানে ইন্টারনেট জগতের অত্যন্ত জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং সাইট, যার মাধ্যমে এর সদস্যরা ভিডিও আপলোড, দেখা এবং আদান-প্রদানের কাজ করে থাকে। এখানে ভিডিও পর্যালোচনা অভিমত প্রদানের সুবিধাও রয়েছে। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠিত সাইটটি নির্মাণের পেছনে ছিলেন মূলত পে-প্যাল প্রতিষ্ঠানের তিন প্রাক্তন চাকুরীজীবী- চ্যাড হারলি, স্টিভ ব্যান আর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জাভেদ করিম
স্কাইপঃ স্কাইপ (Skype) একটি ভিওআইপি সেবা এবং সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমে ব্যবহারকারী ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে পরস্পরের সাথে ভয়েস, ভিডিও এবং তাৎক্ষণিক বার্তার সাহায্যে যোগাযোগ করে থাকেন। ২০০৩ সালে ডেনমার্কের ধমিজা, জানুজ ফ্রিজ এবং সুইডেনের নিকলাস জেনস্ট্রম স্কাইপ প্রতিষ্ঠা করেন
অন্যান্য মাধ্যমঃ উপরে বর্ণিত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়াও আরও কিছু  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে যেমন : মাইস্পেস, ব্লগিমেট, এওএল ইন্সট্যান্ট মেসেঞ্জার, ফেসটাইম (ম্যাকিন্টোল), গুগল টক, গুগল ভয়েস, আইসিকিউ, আইবিএম লোটাস সেমটাইম, উইন্ডোজ লাইভ মেসেঞ্জার, জিমেইল, ইয়াহু মেসেঞ্জার ইত্যাদি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বাংলাদেশঃ সামাজিক যোগাযোগের আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোর ব্যাপক প্রভাব দেখা যায় সারা বিশ্বজুড়ে। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও পিছিয়ে না থেকে দেশীয় কিছু যোগাযোগের মাধ্যম গড়ে তুলেছে। যেমন-
* বেশতো ডট কম হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের প্রথম বাংলা মাধ্যম। যার দ্বারা বাংলা ভাষাভাষীরা সম্পূর্ণ বাংলায় নিজের মতামত অনুভূতিগুলো পরস্পরের সাথে বিনিময়ের সুযোগ পায়
* সাম হোয়্যার ইন ব্লগ একটি সামাজিক ব্লগিং সাইট। টুইটার বা অন্যান্য সার্ভিসে ১৪০ শব্দের বেশি লেখা যায় না কিন্তু এই ব্লগ সাইট ছোট বড় ব্লগ লেখার সুবিধা রয়েছে
* সব ধরণের তথ্য সম্বলিত আরেকটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে বিডি অল ইনফো। যেটি রুয়েটের তড়িৎকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মারছুছ, যন্ত্রকৌশল বিভাগের সাদ্দাম মিলে তৈরি করেছেন
* ফেসবুকের সব ধরণের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে চালু হয়েছেহাউকাউডটকম। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি, চ্যাট, ভিডিও আপলোড এবং গ্রুপ তৈরি করা যায়
* বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের লোকজনের কেনাকাটার খবর জানার জন্য তৈরি হয়েছে ফেরিওয়ালা নামক সাইট
* বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মাধ্যম হলো ক্যাফে ইয়ার্ড। সামাজিক নেটওয়ার্কিং এর সকল সুবিধাসহ এই ওয়েবসাইটে বিশেষ কিছু ফিচার সুবিধা রয়েছে
* ইন্টারনেটের বিশাল জগতে বয়স্ক থেকে তরুণ সবার ধারণা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে নগরবালক নামক মাধ্যমটি
* সংগীত প্রেমীদের সামাজিক মাধ্যমগুলো হলোÑ মিউজিক জলসা, মূর্ছনা, পোলাপাইন মিউজিক, মিউজিক ফূর্তি, ফ্রী ডট কম, বিডি বাংলা প্রভৃতি
এছাড়া আরো কিছু দেশীয় মাধ্যম হচ্ছে ফেসকই, মাইলিমেক্স, রংমহল, বিডিস্পট, আওয়াজ, ফ্রেইন্ডফেইস বাংলাদেশ, এফএনএফ পিয়ার ডট কম ইত্যাদি
সুবিধাসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। যেমন-
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভৌগোলিক দূরত্বের বাধাকে অতিক্রম করে মানুষকে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে
- যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে পুরনো বন্ধু খোঁজা, নতুন বন্ধু তৈরি করা ছাড়াও নিজের বৃত্তের বাইরে অন্যকেও আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব
- এই মাধ্যমগুলোতে খুব সহজে বিভিন্ন সংবাদ তথ্য পাওয়া যায়
- এর সদস্য হতে খুব একটা খরচ লাগে না। একইভাবে কম শিক্ষিতরাও সহজে ব্যবহার করতে পারে
- সামাজিক মাধ্যমগুলো বিভিন্ন ভাষা সমর্থন করে। পাশাপাশি এগুলোর ব্যবহারিক শব্দও মোটামুটি সহজ
- স্বাধীন মত প্রকাশ এবং ভালো লেখক সৃষ্টিতে সামাজিক মাধ্যমগুলোর ভূমিকা রয়েছে
অসুবিধা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সুবিধার পাশাপাশি বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন-
- সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপব্যবহারে নৈতিক অবক্ষয় সামাজিক বিপর্যয় ঘটছে
- এই মাধ্যমগুলো সহজে ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা তাদের সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছে
- শিশুদের সুস্থ বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। সেই সাথে তাদের শরীরের ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে যেমন- আর্থরাইটিস, স্থুলতা, স্মৃতিশক্তি দুর্বল, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মানুষ তাদের জীবনের নানা দিক তুলে ধরছে। ফলে সুবিধাবাদী দেশগুলো গোয়েন্দা নিরাপত্তায় এই মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে
উপসংহারঃ বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যেটি পৃথিবীর দূরত্বকে হাতের মুঠোয় আনতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এর নেতিবাচক দিকগুলো সচেতনতার সাথে পরিহার করে ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে পারলে দেশ তার জনগণ উভয়ই উপকৃত হবে

No comments

Powered by Blogger.