108. বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষসম্পদ উন্নয়ন
ভূমিকা: প্রকৃতি সব সময়ই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সে পরিবেশকে রক্ষা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করে বৃক্ষরাজি অর্থাৎ তার বিস্তৃত বনাঞ্চল। কিন্তু সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এবং নিজেকে সভ্য করে তুলতে মানুষ অবাধে আঘাত হেনেছে প্রকৃতির রক্ষাকবচ এই বৃক্ষের ওপরে। ফলে প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া দেখতেও আমরা বাধ্য হয়েছি এবং হচ্ছি। একের পর এক আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যেখানে কোনো দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে বেশিরভাগ দেশই তা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে বৃক্ষহীনতায় পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে মরুভূমির সৃষ্টি হচ্ছে।
বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা: বৃক্ষের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের সম্পর্ক। আমাদের জীবন ও
জীবিকার জন্য বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। বৃক্ষ সমস্ত প্রাণীর খাদ্য যোগান দেয়। বিশাল এ প্রাণীজগৎকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন দেয়। সেই সাথে প্রাণীজগৎকে বিপন্নকারী কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে। তার সুবিশাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বৃক্ষ দগ্ধ পৃথিবীকে শীতল করে। বন্যা, ক্ষরা, ঝড় নিয়ন্ত্রণ করে বৃক্ষ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। আবহাওয়া ও জলবায়ুকে নাতিশীতোষ্ণ রাখে। মাটিকে উর্বর করে তোলে। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া রোধ করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলে বৃক্ষ। আমাদের জীবনযাপনের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- আসবাবপত্র, জ্বালানি, কাঠ, গৃহনির্মাণ, রেল লাইনের স্লিপার, নৌকা, লঞ্চ, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণে যে বিপুল পরিমাণ কাঠ প্রয়োজন হয় তা আসে এই বৃক্ষ থেকে। বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল যেমন রেয়ন, পেন্সিল, কাগজের মন্ড, দেশলাইয়ের কাঠি ও বাক্স, কর্পূর, রাবার ইত্যাদি আমরা বৃক্ষ থেকে পাই। জীবন রক্ষাকারী ভেষজ বিভিন্ন ওষুধের মূল্যবান উপাদানও বৃক্ষই সরবরাহ করে।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি: জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের উন্নত ও সুসভ্য দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে বেশিমাত্রায় বনভূমি ধ্বংস করছে। কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পড়ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপরে। উন্নত দেশগুলোর অধিক হারে বৃক্ষনিধনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বায়ুম-লের ওজনস্তরে ফাটল ধরেছে। যার ফলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের মতো মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থার প্রতিকার এখনই করা না হলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে সারাবিশ্বে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুন হয়ে যাবে এবং জীবনযাত্রা চরম ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
বাংলাদেশে বনভূমির অবস্থা: বাংলাদেশে ভূখন্ডের মোট আয়তনের তুলনায় মাত্র ১৭.০৮ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। আমাদের দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ২.৫২ মিলিয়ন হেক্টর। মোট বনানঞ্চলের মাত্র ৪৫ শতাংশ এলাকায় গাছপালা রয়েছে। আমাদের দেশজ উৎপাদনে বনজ সম্পদের অবদান ১.৬৬% এবং কৃষিখাতে এর অবদান ১৩.২৪%। উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে তিন ধরণের বনভূমি আছে। এগুলো হলো-
১। ক্রান্তীয় চিরহরিৎ ও পত্রপতনশীল বনভূমি: চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রয়েছে এই বনভূমি। চাপালিস, গর্জন, গামারি, জারুল, কড়ই প্রভৃতি হলো এ বনভূমির প্রধান বৃক্ষ।
২। শালবন: ময়মনসিংহ, গাজীপুর (ভাওয়ালের গড়) ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে এ বনভূমি অবস্থিত। এছাড়া রংপুর ও দিনাজপুরেও সামান্য পরিমাণে বনভূমি রয়েছে। এ বনাঞ্চলের প্রধান বৃক্ষ শাল, এছাড়া ছাতিম, কড়ই ও হিজলও আছে।
৩। স্রোতজ বনভূমি: বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজার জেলায় এই বনভূমি অবস্থিত। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎস্রোতজ বা ম্যানগ্রোভ বন। এই বনাঞ্চলের প্রধান বৃক্ষ হলো সুন্দরী।
বৃক্ষরোপণ কেন প্রয়োজন: সভ্যতাকে আরও এগিয়ে নিতে এবং শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই আমরা বনাঞ্চল ধ্বংস করছি। আর এর সবই করছি বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে। নিজেদেরকে উন্নত দেশগুলোর কাতারে নেয়ার চেষ্টায় উন্নয়নশীল দেশগুলো অবিরাম ছুটে চলেছে। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলো চেষ্টা করছে নিজেদেরকে আরও উন্নত করতে। আর এসব করতে গিয়ে সমস্ত চাপ এসে পড়ছে প্রকৃতির উপর। বিশেষ করে বনভূমির ওপর। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যনতুন সমস্যা। আর এই সকল সমস্যা প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে বনায়নের জন্য কাজ করতে হবে। যে সমস্ত সমস্যা মোকাবেলায় আমাদেরকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে তা হলো-
১। প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ: ২০০৭ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আমেরিকান রাজনীতিবিদ ‘আল গোর’ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ হিসেবে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে দায়ী করেন এবং এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি অধিক জনসংখ্যা এবং তাদের চাহিদাপূরণের লক্ষ্যে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এর কথা বলেন। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেই আমরা স্বল্প বিরতিতে বিভিন্ন ঝড়, ক্ষরা, নদী ভাঙন, বন্যার সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের দেশে উপকূলীয় দুর্যোগ রক্ষা করে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে।
২। বায়ুদূষণ রোধ: বৃক্ষ পরিবেশ থেকে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে। কিন্তু অধিক হারে বৃক্ষনিধনের ফলে দিন দিন বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃক্ষহীনতার ফলে বায়ু দূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য যে সকল উৎসগুলো আছে সেগুলোকেও পরিবেশ নিজ ক্ষমতায় পরিশোধন করতে পারছে না। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বায়ু দূষণ এবং এই কারণে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগে। তাই এই বায়ুদূষণ এবং তার থেকে সৃষ্ট রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বনায়ন করতে হবে।
৩। গ্রিন হাউজ ইফেক্ট প্রতিরোধ: বিজ্ঞানীদের মতে এই গ্রিন হাউজ ইফেক্টের ফলে নিকট ভবিষ্যতে আর্কটিক মহাসাগরের বিশাল বরফ স্তর গলে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাবে। আর তা যদি ১ মিটারও বাড়ে তাহলে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ, বিশেষ করে মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আর তাই এর থেকে নিস্তার পেতে হলে আমাদেরকে অধিক হারে বনায়ন করতে হবে।
৪। ভূমি ক্ষয়রোধ: বনভূমি ধ্বংসের ফলে ভূমিক্ষয় বৃদ্ধি পায় এবং ক্ষরা ও মরুকরণ দেখা দেয়। তাই ভূমিক্ষয় রোধের জন্য বৃক্ষরোপণ করা খুবই প্রয়োজন।
বৃক্ষরোপণ অভিযান: রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘দাও ফিরিয়ে সেই অরণ্য, লও এ নগর’। অর্থাৎ তার সময়েই তিনি বনভূমির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, তবে বর্তমানে আমাদের সরকারগুলোও বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। আর তা সবাইকে অনুধাবন করাতে সরকার বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচাতে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহকে বেছে নেয়া হয়েছে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ হিসেবে। মৌসুমী বৃষ্টিপাত হওয়ায় এই সময়কে বৃক্ষরোপণের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন নার্সারি থেকে লক্ষ লক্ষ চারা গাছ জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে বিতরণ করছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সংস্থাও এই অভিযানে এগিয়ে এসেছে। সরকার সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিক্ষয় রোধে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে উপকূলবাসীকে সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে।
বনভূমি উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগ: বনজ সম্পদ উন্নয়ন ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য সরকার বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন সংস্থা গড়ে তুলেছে। গঠন করেছে বন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বেসরকারিভাবে কাঠ ও অন্যান্য দ্রব্য আহরণ নিষিদ্ধ করেছে। বনভূমি সম্প্রসারণের জন্য বনের আশেপাশের জমি সরকারি দখলে নেয়া হয়েছে এবং সেখানে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে সারাদেশে ৫২,০০০ একর জমিতে এবং সমুদ্র উপকূলে ৪০,০০০ একর জমিতে বনভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ১৩,০০০ একর জমিতে নতুন বনভূমি সৃষ্টি করা হয়েছে আর প্রায় ১৫,০০০ একর জমিতে নতুন বনভূমি সৃষ্টি করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বনভূমি উন্নয়নে করণীয়: দেশের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য বনভূমি ও বনজ সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমির পরিমাণ অত্যন্ত কম। অবাধে বৃক্ষ নিধনের ফলে আমাদের বনভূমি সংকুচিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য প্রয়োজনে এই বনভূমি ও বনজসম্পদের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। আর এ জন্য যা করণীয়-
* নতুন বনভূমি গড়ে তুলতে হবে। নদীর তীরবর্তী অঞ্চল, উপত্যকা, পাহাড়ি উচ্চ এলাকা ও সমুদ্র উপকূলে পর্যাপ্ত বনায়ন করতে হবে।
* নির্বিচারে বৃক্ষনিধন রোধ করতে হবে। মূল্যবান বৃক্ষসমূহ সরকারি অনুমতি ছাড়া নিধন করা নিষিদ্ধ করতে হবে।
* সরকারি তত্ত্বাবধানে বনাঞ্চল সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বনজ সম্পদ রক্ষায় ও এর উন্নয়নের জন্য বনবিভাগের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বনবিভাগীয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতি দমন করতে হবে।
* বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অভয়ারণ্য গঠন ও সংরক্ষণ করতে হবে। জনগণকে সচেতন হতে হবে। বিনামূল্যে জনগণের মাঝে চারাগাছ বিতরণ করতে হবে।
* বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহের জন্য যেন আর কোনো গাছ কাটা না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাটা হলেও সেখানে নতুন গাছ লাগিয়ে যেন সেই শূন্যতা পূরণ করা হয়। জ্বালানি হিসেবে কাঠের বিকল্প খুঁজতে হবে।
* বৃক্ষরোপণ অভিযানকে শুধুমাত্র একটি সপ্তাহে সীমাবদ্ধ না রেখে বছরের অন্যান্য সময়ে তা চালিয়ে যেতে হবে।
* চোরাইপথে বৃক্ষনিধন প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য সরকার এবং জনগণকে সচেষ্ট হতে হবে।
উপসংহার: বৃক্ষহীন একটি পৃথিবীতে আমরা কখনই বেঁচে থাকতে পারব না। আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই বনায়নের ওপর অর্থাৎ বৃক্ষরোপণের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যক্তিগত পারিবারিক উন্নয়ন এবং জীবন ও জীবিকার তাগিদে আমাদেরকে বনভূমির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করতে হবে। শুধুমাত্র সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়েই নয় বরং ব্যক্তিগতভাবেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে এবং সেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
No comments