100. স্বদেশপ্রেম
ভূমিকা: নিজ দেশ ও জন্মভূমির প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের প্রকৃতি ও ধূলিকণা আমাদের নিকট অতি প্রিয় ও পবিত্র। শিশুকাল থেকেই মানুষ স্বদেশের মাটিতে বেড়ে ওঠে। মায়ের বুক যেমন সন্তানের নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়, স্বদেশের কোলে মানুষ তেমনি নিরাপদ ও নিশ্চিত আশ্রয় লাভ করে। স্বদেশকে ভালোবাসার মাঝেই মানব জীবনের চরম সার্থকতা নিহিত। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
“সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।”
স্বদেশপ্রেম কী: স্বদেশপ্রেম মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে
সেটিই তার জন্মভূমি। জন্মভূমির প্রতি, স্বজাতির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধাবোধই স্বদেশপ্রেম। দেশপ্রেমীর নিজ দেশের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা, সীমাহীন আনুগত্য। বিশ্বের উন্নত জাতিগুলো স্বদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। স্বদেশপ্রেম না থাকলে দেশ ও জাতির উন্নতি আশা করা যায় না। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সুখী দেশ গড়তে হলে তাই নাগরিকদের অবশ্যই স্বদেশপ্রেমী হতে হবে।
স্বদেশপ্রেমের উৎস: প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের দেশকে ভালোবাসে। সকল জীবের মধ্যেই এ গুণ বিদ্যমান। বন্যপশুকে বনভূমি ছেড়ে লোকালয়ে আনলে, পাখিকে নীড়চ্যুত করলে তারা আর্তনাদ শুরু করে। এটি করে নিজ আবাসস্থানের প্রতি ভালোবাসার টানে। নিজ আবাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি, পানি, আলো, বাতাস যেন আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গহানির শামিল। এগুলোর প্রতি মমত্ববোধ থেকেই সৃষ্টি হয় স্বদেশপ্রেম। দেশের মাটির প্রতি মমত্ববোধের সাথে মিশে থাকে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও গৌরববোধের আকাঙ্ক্ষা।
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ : মানুষ সমগ্র বিশ্বের বাসিন্দা হলেও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে সে বেড়ে উঠে। একটি বিশেষ দেশের অধিবাসী হিসেবে সে পরিচয় লাভ করে। এ দেশই তার জন্মভূমি, তার স্বদেশ। মানুষ স্বদেশে জন্মগ্রহণ করে ও স্বদেশের ভালোবাসায় লালিত-পালিত হয়। নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার সকল উপাদান সে স্বদেশ থেকে পায়। ফলে স্বদেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়। এ জন্য মানুষ স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত হয় এবং স্বদেশের অপমানে অপমাণিত হয়। স্বদেশের স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। কবি ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখেছেন-
“মিছা মনিমুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রত্ন নাই আর।”
স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ: স্বদেশপ্রেম মানব হৃদয়ে লালিত হয়। আর স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে মানুষের কর্মের মাধ্যমে। স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষায়, স্বদেশের মানুষের কল্যাণ সাধনে মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম জেগে ওঠে। যাঁরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, দেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন তাদের নাম ও কীর্তি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁদের সে প্রেম ও আত্মত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে চিরকাল। স্বদেশের তরে জীবন উৎসর্গকারীরা সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-
ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
দেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ: কেবল দেশকে ভালোবাসার মধ্যে দেশপ্রেম সীমাবদ্ধ নয়। দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেওয়া যেমন শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে অবদান রাখাও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। সম্প্রতি ২৬ মার্চ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা গাইতে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৬৮১ জন মানুষের একত্রিত হওয়া দেশপ্রেমরই বহিঃপ্রকাশ। দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে বিশ্বসভ্যতায় গৌরব বাড়ানো যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ড. মুহাম্মদ ইউনুস, সাকিব আল হাসান প্রমুখের গৌরবময় অবদানের জন্য বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। দেশপ্রেমের উজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ আমরা নবী করীম (স.) এর মধ্যে দেখতে পাই, দেশকে ভালোবেসে তিনি বলেছিলেন- “হে মাতৃভূমি তোমার লোকেরা যদি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করত তবে আমি কখনই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম: স্বদেশকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। স্বদেশপ্রেম কখনও বিশ্বপ্রেমের বাধা হয় না। দেশপ্রেম যদি বিশ্ববন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসাহিত হতে হবে। যে নিজের দেশকে ভালোবাসে না সে অন্য দেশ, ভাষা, গোষ্ঠী তথা মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না। তাই দেশপ্রেমের মধ্যেই বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটে।
সাহিত্যের আয়নায় দেশপ্রেম: বিভিন্ন কবি সাহিত্যিক তাদের কবিতা, কাব্য, নাটক, গান, উপন্যাস প্রভৃতি লেখনির মাধ্যমে তাদের দেশপ্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বিকাশ ঘটে ব্রিটিশ আমল থেকেই। নীলদর্পণ, আনন্দমঠ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি গ্রন্থে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে। এছাড়া নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখের সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে।
ছাত্রজীবনে স্বদেশ প্রেমের শিক্ষা: স্বদেশপ্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলেও এ গুণটি তাকে অর্জন করতে হয়। তাই ছাত্রজীবন থেকেই দেশপ্রেমের দীক্ষা গ্রহণ করতে হয়। দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ছাত্রজীবনে যে দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় তা মনে আজন্ম লালিত হয়। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশের ভালো-মন্দ তাদের উপর অর্পিত হবে। সবার আগে দেশের বিপদে-আপদে ও প্রয়োজনে ছাত্রদেরকেই এগিয়ে আসেত হবে। প্রয়োজনে দেশের স্বার্থে ছাত্রদেরকে জীবন উৎসর্গ করতে হবে। যেমনটি ছাত্ররা করেছিল ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে প্রাণ উৎসর্গ করে।
স্বদেশপ্রেমের প্রভাব: স্বদেশেপ্রেমের মহৎ চেতনায় মানব চরিত্রের সৎ গুণাবলি বিকশিত হয়। মানুষের মন থেকে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা দূর হয়। স্বদেশপ্রেম মানুষকে উদার ও মহৎ করে, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। স্বদেশপ্রেমের কারণেই মানুষ আত্মসুখ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণ করে, দেশবাসীকে ভালোবাসো।
স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত: যুগে যুগে অসংখ্য মনীষী স্বদেশের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নাম না জানা লক্ষ লক্ষ শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য জীবন দিয়ে অমর হয়েছেন। বিশ্ব অঙ্গনে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত রেখেছেন চীনের মাওসেতুং, রাশিয়ার লেলিন ও স্ট্যালিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন প্রমুখ ব্যক্তি। দেশেপ্রেমের জন্যেই তাদের সকলের নাম বিশ্বের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি ও দেশপ্রেম: নগর কেন্দ্রীক সভ্যতায় মানুষ তার পাশের বাড়ির মানুষের কথাই ভুলে গেছে। মানুষ আজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দেশের মানুষের চিন্তা করার মানসিকতা তার নেই। মানুষের মধ্যে বাঁচার তাগিদ আজ আর কেউ অনুভব করে না। কেননা মানুষের মধ্যে বাঁচা মানে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য বাঁচা। কিন্তু সবাই এখন নিজের জন্য বাঁচতে চায়। তাই দেশ ও জাতির জন্য আমাদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
উগ্র দেশপ্রেম: দেশপ্রেম দেশ ও জাতির জন্য গৌরবের। কিন্তু উগ্র দেশপ্রেম ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা উগ্র দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ। জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনির উগ্র জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই উগ্র দেশপ্রেম সব সময় অশুভ, চির অকল্যাণকর ও চির অশান্তির।
উপসংহার: জন্মভূমি সকলেরই প্রিয়, তা রক্ষার দায়িত্বও সকলের। তবে মনে রাখতে হবে নিজের দেশকে রক্ষার নামে অপরকে আক্রমণ করা মানবতাবিরোধী। স্বদেশপ্রেমের মতো পবিত্র গুণ আর নেই। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের উচিত স্বদেশকে ভালোবাসা। প্রকৃত দেশপ্রেমী মানুষ সকলের কাছে পরম পূজনীয়। দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মত্যাগকারী ব্যক্তিই বিশ্ববরেণ্য।
No comments