13.আমার প্রিয় কবি
ভূমিকা:
বল বীর-
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত-শির ঐ শিখর হিমাদ্রির (কাজী নজরুল ইসলাম)
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আবির্ভাব উন্নত শির হিমাদ্রির মতো বা ঊর্ধ্ব থেকে নিম্নে পতিত প্রবল শক্তিধর জলপ্রপাতের মতো। কারো কারো মতে, বাংলা সাহিত্যে তাঁর উজ্জ্বল প্রবেশ যেন ধূমকেতু বা ঝঞ্ঝার মতোই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর্যায়ভুক্ত। বাংলা কাব্যের শান্ত সরোবরে সমুদ্রের তরঙ্গ সঞ্চারিত করেছেন তিনি। তাই বাঙালি পাঠকের কাছে তাঁর
পরিচয় ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল।
পরিচয় ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল।
পরিচয়
নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ফকির আহমদ, মাতার নাম আমিনা বিবি। নজরুলের জীবনে তাঁর কাকা ফজলে করীমের প্রভাব অপরিসীম। নজরুলের বাল্যশিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যেত, যদি কাকার সহায়তা নজরুল না পেতেন। নজরুলের মৃত্যু ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তাঁর পূর্বেই দুরারোগ্য অসুখে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
নজরুলের জীবন বিচিত্র কর্মবহুল, সদাচঞ্চল, অভিনব এবং প্রতিভাদীপ্ত। শৈশব থেকে তাঁর শিক্ষানুরাগের প্রকাশ এবং সেই অনুরাগকে সার্থক করার বাসনায় তাঁর দেশান্তর গমন। অবশ্য পরিস্থিতিগত কারণ ও চঞ্চল স্বভাবের জন্য অকালেই বিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়ে তরঙ্গমুখর জীবন প্রাঙ্গণ থেকে তাঁকে শিক্ষা নিতে হয়েছে। যদিও তিনি বর্ধমানের ছেলে, তবুও তাঁর বাল্যশিক্ষার শুরু বাংলাদেশের ময়মনসিংহের একটি বিদ্যালয়ে। কিন্তু অল্পদিন পরেই আবার তাঁর বর্ধমানে প্রত্যাবর্তন। সেখানে মাথরুন ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। থাকা-খাওয়ার অসুবিধার জন্য কবি এই বিদ্যালয় থেকেও বিদায় নেন। সপ্তম শ্রেণিতে উঠে তিনি ভর্তি হন বর্ধমানের শিয়ার শোল রাজ বিদ্যালয়ে। এখানে ছাত্র হিসাবে তিনি বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর শ্রেণিতে তিনিই শ্রেষ্ঠ ছাত্রের মর্যাদা লাভ করেন। বাৎসরিক পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তিনি একেবারে সপ্তম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উন্নীত হন। এবং সেখান থেকে প্রথম হয়ে দশম শ্রেণিতে। পরের বৎসর ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে তিনি প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষাও দেন। কিন্তু তাঁর পরেই ব্যক্তিগত কারণে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিদায় গ্রহণ করেন এবং প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দেন।
বিচিত্র জীবন
বিচিত্র ও বহুমুখী জীবনযাপন করেছেন নজরুল। তাঁর বয়স যখন মাত্র নয় বৎসর,তখন তিনি মক্তবের শিক্ষকতা করেছেন। বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়েও সেখানকার প্রতিভাদীপ্ত ও উজ্জ্বল সম্ভাবনামুখর জীবনকে ছিন্নপত্রের মতো উড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন মৃত্যু সমাকীর্ণ রণক্ষেত্রে। যুদ্ধে তিনি সাধারণ সৈনিক (হাবিলদার) হয়ে যোগদান করেন। করাচি হেড কোয়াটার্সে তাঁর তিন বৎসর কাটে। যুদ্ধশেষে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন, এবং ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহমেদের সঙ্গে একত্রে বাস করতে থাকেন। সাম্যবাদী চিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি বিশেষ অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেন। অবশ্য নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তা তত্ত্বমুখী নয়। তা সর্বতোভাবে জীবনমুখী এবং উচ্ছ্বাসবহুল। সাম্যবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর কিছু কিছু ক্রিয়াকলাপ উল্লেখের দাবি রাখে। নৈহাটির জগদ্দল অঞ্চলে গানের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে সাম্যবাদী চিন্তার প্রসারচেষ্টা উল্লেখ্য। প্রগতিশীল কিছু পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যুক্ত হন। যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল প্রমীলা দেবীকে বিবাহ করেন। কিন্তু ঘরের মোহ তাঁর সদাচঞ্চল জঙ্গম জীবনকে কোনো ভাবেই রুদ্ধ করতে পারে নি। আশ্চর্য জীবনীশক্তি ও উদ্বেল যৌবন উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি বিদ্রোহীর মতোই জীবনযাপন করেছেন। ধূমকেতুর মতো নজরুল প্রবল আবেগে স্বরচিত গান গাইতে গাইতে বন্ধুদের সভায় হঠাৎ আবির্ভূত হতেন, চর্বিত পানের রক্তিম রঙে ওষ্ঠাধর সর্বদা হয়ে থাকতো রাঙা। সারা দেশকে যৌবনশক্তির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন।
বিদ্রোহী কবি নজরুল
বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে বিদ্রোহাত্মক কবিতা নিয়ে নজরুলের বাংলা সাহিত্যে দীপ্ত আবির্ভাব। কবির বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ‘মোসলেম ভারত’ নামক সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হতেই বাংলা সাহিত্যে সাড়া পড়ে যায়। সচেতন পাঠক অনুভব করেন, বাংলা সাহিত্যে একজন অভিনব ও অমিত শক্তিধর কবির আবির্ভাব হয়েছে। এই নতুন কবির কবিতায় ও গানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-বিকীর্ণকারী বিদ্রোহ-চেতনা, চিরাচরিতের শাসন-নাশন বিপ্লবের আহ্বান। এর ফলে বাংলাদেশের পাঠকসাধারণের কাছে তিনি হলেন ‘বিদ্রোহী কবি’। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার তাঁর কবিতাকে করে তুলল বিদ্রোহাত্মক, ভাষাকে বীর্যবান এবং প্রকাশভঙ্গিকে দীপ্ত। কবি তাঁর কবিতায় শুধু বিদেশি শক্তিকেই আঘাত করলেন না, নিজের দেশের অসাম্য ও দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার ও অন্যায় আচরণকেও করলেন সমালোচনাবিদ্ধ। এসবের ফলে ইংরেজের কারাগারেও তাকে কিছু কাল কাটাতে হয়েছিল। কবির এই বিদ্রোহ চেতনাকে ধারণ করে রচিত হয়েছে তাঁর অগ্নিবীণা’, ‘শিকল ভাঙার গান’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘প্রলয় শিখা’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ।
আরো কাব্য কৃতিত্ব
কিন্তু শুধু বিদ্রোহের উত্তেজনা সঞ্চারেই নজরুলের কাব্যজীবনের সীমা নয়। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এত বড় অসাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিক মিলনের কবিও বাংলা সাহিত্যে আর কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। তাঁর কবিতা ও সংগীত হিন্দু ও মুসলমান সংস্কৃতির মিলনাত্মক ঐক্যবদ্ধ ভারতের এমন এক নিবিড় উপলদ্ধি সঞ্চার করে দেয়, যার তুল্য ভিন্নতর দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। সমালোচক আজাহারউদ্দীন যথার্থই বলেছেন, একদিকে হিন্দু সংস্কৃতির মনীষা, ত্যাগ ও তপস্যা, অপরদিকে মুসলিম সংস্কৃতির দুর্বার তেজ ও দুরন্ত সাহসের অপূর্ব মিশ্রণে যে দিব্যমানবত্বের সৃষ্টি হয়, কবি নজরুলের সাহিত্য সেই রসাদর্শের সাহিত্য।
প্রেম ও প্রকৃতির কবি-গীতিকার নজরুল
বিদ্রোহী মনোভাবের বাইরে নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতিনির্ভর গান ও কবিতার সংখ্যাও কম নয়। তাঁর প্রেম-কবিতা ও প্রকৃতি-কবিতার সর্বাঙ্গ ব্যাপ্ত করে যে আবেগ, অনুভব ও হিল্লোল বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রোত্তর যুগে তাঁর সমধর্মী কবিতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া তাঁর ভক্তি সংগীতও কম নয়। কবির বিদ্রোহ চেতনার সঙ্গে প্রেম, প্রকৃতি চিন্তা ও ভক্তি সম্মেলন তাঁর কবিমানসকে মানবিকতায় সম্পূর্ণতা দিয়েছে। কবির উপরিউক্ত বিশিষ্টতাগুলি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘চক্রবাক’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ও শ্যামাসংগীত সংকলনে। কবি শিশুদেরও অবহেলা করেননি। পরম ভালোবাসায় তাদের জন্য রচনা করেছেন ‘ঝিঙে ফুল’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি। নজরুলের কবিমানসের অনাবিল উজ্জলতার আর একটি পরিচয়, রবীন্দ্রোত্তর কবিকূলের অধিকাংশ রবীন্দ্রনাথের প্রতি সূক্ষ্ম বা স্থুল যে ঈর্ষা পোষণ করতেন, নজরুল ছিলেন তাঁর থেকে সর্বাংশে মুক্ত।
উপসংহার
নজরুলের কবিতা একদা বাংলা সাহিত্যে যে প্রবল উন্মাদনা ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ সৃষ্টি করেছিল, তাঁর সম্পূর্ণ অবসান আজও হয় নি। সেদিন বাংলাদেশের যুবসমাজের কাছে তিনি দেশমুক্তির অগ্রণী তুর্যবাদকরূপে গৃহীত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে বসন্তের অগ্রদূত’ রূপে অভ্যর্থনা করেছিলেন। অবশ্য তাকে ঘিরে সেদিনের সেই উচ্ছাস আজ কিছুটা স্তিমিত। কারণ তাঁর কবিতার প্রকাশশক্তি অসাধারণ বীর্যবত্তার অভ্যন্তরে হয়তো মননের দুর্বলতাও সম্পূর্ণ দুর্লক্ষ্য থাকে নি। একথাও হয়তো অসত্য নয়, তাঁর কবিতার কঠোর প্রকাশভঙ্গি বহু সময় কবির বিশিষ্টতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও অনস্বীকার্য যে, তাঁর কবিচেতনার আন্তরিকতা ও উচ্চনিনাদী আঙ্গিক তাঁর কবিতাকে স্ফূর্ত প্রাণাবেগে পূর্ণ করেছে।
No comments