119. মহত্ত্ব
ভূমিকা: মানুষের যে সকল গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য মানুষকে সত্যিকার অর্থেই ‘মানুষ’ করে তোলে তার মধ্যে অন্যতম হলো মহত্ত্ব। যদিও আমরা মানব শিশু হয়েই জন্মগ্রহণ করি তবু মানুষ হয়ে উঠতে আমাদেরকে অনেক বেগ পেতে হয়। প্রাণ থাকলেই যে কেউ প্রাণী হিসেবে পরিচিতি পায় কিন্তু মানুষ হতে হলে আমাদের মধ্যে থাকতে হয় মনুষ্যত্ব। পশুদের মধ্যে ‘পশুত্ব’ অর্জনের কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু আমাদেরকে মনুষ্যত্ব, মহত্ত্ব নিজেদের ভেতর ধারণ করতে হয়। তবেই আমরা মানুষ হতে পারি। মনুষ্যত্ব বা মহত্ত্ব ছাড়া যে মানুষ বেঁচে থাকে তাকে তুলনা করা হয় পশুর সাথে। পশুদের মধ্যে যেমন কোনো বিবেচনাবোধ থাকে না, বিবেক
থাকে না তেমনি ন্যূনতম মনুষ্যত্ব আর মহত্ত্ব যার মধ্যে নেই সেও বিবেক-বিবেচনাহীন নামমাত্র মানুষ। প্রকৃত পক্ষে মানুষ হওয়ার যোগ্যতা সে অর্জন করতে পারে না।
মহত্ত্ব: মহত্ত্ব হলো এমন একটি মানবীয় গুণ যা মানুষের সৎগুণগুলোর সম্মিলিত একটি অবস্থাকে নির্দেশ করে। আর এই মহত্ত্ব মানুষের নিজস্ব আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। মহত্ত্ব হলো মানুষের সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা তাকে মহান করে তোলে। লিও তলস্তয়ের মতে- ‘সারল্য, সততা আর সত্যের সম্মিলিত রূপ হলো মহত্ত্ব’। প্রকৃতপক্ষে মহত্ত্ব হলো এমন একটি গুণ যা সংজ্ঞায়িত করা মোটেও সহজ নয়। বরং তা অনুভব করা সহজ।
মহত্ত্বের স্বরূপ: আত্মসুখে মগ্ন না থেকে পরের মঙ্গল সাধন করা, সমাজ, সভ্যতা, দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করা, নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাবা, ব্যক্তি স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সমষ্টিগত স্বার্থকে রক্ষা করা এগুলো সবই মহত্ত্বের লক্ষণ। মহত্ত্ব এমন একটি শক্তি যা মানুষকে সবসময় কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। সকল প্রকার স্বার্থপরতা, কলুষতা, সংকীর্ণতা, হীনতা, কুপ্রবৃত্তি, পরশ্রীকাতরতা থেকে দূরে রেখে মহত্ত্ব মানুষকে আলোর পথের যাত্রী করে। মহত্ত্ব হলো সেই গুণ যা মানুষকে আত্মোৎসর্গ করতে শেখায়। মহত্ত্ব হলো সেই বিমূর্ত ধারণা যা একজন নামমাত্র মানুষ এবং সত্যিকার অর্থে মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। মহত্ত্ব মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে দূরে রাখে এবং একই সাথে তাকে পরার্থপরতার চর্চা করতে শেখায়।
মহত্ত্ব অর্জনের উপায়: জগৎ বিখ্যাত লেখক ও নাট্যকার শেক্সপিয়ারের মতে- ‘কেউ কেউ মহৎ হয়ে জন্ম নেয় আবার কেউ কেউ মহত্ত্ব অর্জন করে।’ জন্মসূত্রে কেউ কেউ হয়তো মহত্ত্বের কিছু বৈশিষ্ট্য লাভ করে কিন্তু তাকে মহৎ হতে উৎসাহী কিংবা নিরুৎসাহী করে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। তাই মহত্ত্ব যতখানি সহজাত তার চেয়ে বেশি অর্জনের বিষয়। পরিবার ও সমাজের অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুর সামাজিকিকরণ ঘটে সেগুলোর ইতিবাচক অবস্থা মানুষের ভেতরে সৎ গুণগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটায়। অন্যদিকে নেতিবাচক পরিবেশে ব্যক্তির সৎ হয়ে ওঠা ব্যাহত হয়। যে শিশুটি ছোটবেলা থেকেই হিংসা-বিদ্বেষ আর সহিংসতায় বড় হয় তার জন্য মহত্ত্ব নতুন ধারণা, তাই মহত্ত্ব অর্জন করা তার জন্য সহজ নয়। আর তার কাছে সেটা প্রত্যাশাও করা যায় না। কিন্তু যে শিশু বড় হয় এমন কোনো পরিবেশে যেখানে সবাই সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে। সম্প্রীতি বজায় রেখে চলে, সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হয় সে শিশুর মধ্যে অল্প বয়সেই মহত্ত্বের লক্ষণ দেখা যায়। মহত্ত্ব অর্জনের আদর্শ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। যে পরিবারের সদস্যরা মনুষ্যত্বে বিশ্বাসী, মানব সেবা আর অন্যের মঙ্গল সাধন যাদের ধর্ম, সেই পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশু সময়ের সাথে সাথেই মহত্ত্ব অর্জন করে। আবার মানুষ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন বলে অনেকে হয়তো প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও নিজের বিচার বিবেচনা দিয়ে মহৎ হতে পারে। তবে মহত্ত্ব অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সঠিক সামাজিকীকরণ।
মহত্ত্ব ও চরিত্র: একজন মানুষের চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়েই তার ভেতরে মহত্ত্ব, মনুষ্যত্ব কিংবা পশুত্ব প্রকাশ পায়। সৎ চরিত্রের একজন মানুষ মহৎ হবে, মনুষ্যত্বকে বহন করবে এটাই স্বাভাবিক। আবার যে মানুষ অসৎ চরিত্রের অধিকারী, তার মধ্যে মহত্ত্বের ছিটেফোটাও থাকবে না এটাও স্বাভাবিক। কারণ তারা নীতি নৈতিকতা, ভালো-মন্দ বিচার করে না, স্বার্থপরতাকে জীবনের আদর্শ করে তারা বেঁচে থাকে। আর যারা মহত্ত্বকে জীবনের আদর্শ করে তারা সর্বদাই সৎ চরিত্রের অধিকারী হয়। একজন মানুষের অঢেল বিত্ত থাকতে পারে, সে পরিশ্রমী হতে পারে, তার হাতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে মহত্ত্ব নাও থাকতে পারে। আবার একজন দরিদ্র মানুষ, যার কোনো বিত্ত নেই, ক্ষমতা নেই, কর্তৃত্ব নেই তার মধ্যেও মহত্ত্ব থাকতে পারে। মহত্ত্ব কখনো ব্যক্তির সামাজিক অবস্থা ও মর্যাদার ওপর নির্ভর করে না, বরং মহত্ত্ব নির্ভর করে তার ইচ্ছা ও মানসিকতার ওপর।
মহত্ত্ব ও মানবতা: যারা মানবতায় বিশ্বাসী, মানুষকে ভালোবাসে, মানবপ্রেম আর মানবসেবাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নেয় তাদের ভেতরই মানুষ মহত্ত্বকে আবিষ্কার করে। প্রকৃতপক্ষে মহত্ত্বের মূল ভিত্তি হলো মানবতাবোধ। যে ব্যক্তির মধ্যে ন্যূনতম মানবতাবোধ থাকে না সে ব্যক্তি কখনো মহত্ত্বকে উপলব্ধি করতে পারে না। মানবতা ও মহত্ত্ব তাই একই সুতায় গাঁথা। সেই ব্যক্তি মহৎ যে মানব প্রেমকে নিজে ধর্মে পরিণত করে এবং মানব সেবাকে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করে। মানবতা বোধে উদ্বুদ্ধ মানুষ আপন স্বার্থ ভুলে গিয়ে সকলের মঙ্গলের জন্য আত্মোৎসর্গ করেন। পরের কল্যাণ সাধনাই তার চিন্তা-চেতনা আর ধ্যানজ্ঞানে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তি মহৎ হয়ে ওঠে আর তার মহত্ত্ব চির ভাস্বর হয়ে থাকে।
মহত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা: ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন ব্যবস্থা সবখানেই মহত্ত্ব একটি অনন্য সাধারণ গুণ হিসেবে কাজ করে। সকলের জন্য কল্যাণকামী একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মহত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি খুবই সংকটাপন্ন। সহিংসতা, নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, দখলদারিত্ব, মানুষে মানুষে হানাহানি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এমন একটি পরিস্থিতিতে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে ধরে রাখতে পারে মহত্ত্বের মতো মানবীয় গুণাবলীর স্ফুরণ। যেহেতু মহত্ত্ব মানুষকে মানব প্রেম শেখায়, পরের মঙ্গল করতে শেখায়, নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিতে শেখায়। তাই মহত্ত্ব দিয়েই বিশ্বব্যবস্থার এই সংকটকে মোকাবেলা করা যায়। মহত্ত্ব মানুষকে ক্ষমাশীল করে, উদার করে, অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। আর তাই মহৎ ব্যক্তির মহত্ত্ব দিয়ে তাদের জীবনের নানা সমস্যা অবলীলায় উতরে যান। এক ব্যক্তির মহত্ত্ব আর একজন ব্যক্তির সুখ ও স্বস্তির কারণ হতে পারে। আবার একটি রাষ্ট্রের মহত্ত্ব ও অপর একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুন্দর-সুশৃঙ্খল, মঙ্গলময় একটি জীবন গঠনে তাই মহত্ত্ব প্রয়োজন। শুধুমাত্র ব্যক্তি জীবনই নয় বরং পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে ইতিবাচক ও মানুষের অনকূলে আনার জন্য মহত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মহত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যম: সত্যিকারের মহৎ মানুষেরা কখনই তাদের মহত্ত্বকে জাহির করতে চান না। প্রকৃত পক্ষে মহত্ত্ব লোক দেখানো কোনো বিষয় নয়। বরং মহৎ মানুষেরা না চাইলেও তাদের কর্মকান্ড ও আচার-আচরণে মহত্ত্ব প্রকাশিত হয় তাদের অজান্তেই। এমন নয় যে মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য কাউকে নিজের জীবন দিতে হবে বা তার সর্বস্ব হারাতে হবে, ত্যাগ করতে হবে। বরং খুব ছোট ছোট ভালো কাজের মধ্য দিয়েও ব্যক্তির মহত্ত্ব প্রকাশিত হতে পারে। একজন কর্পোরেট ব্যক্তির লক্ষ টাকা দান করার মধ্যেও হয়তো মহত্ত্বের চেয়ে মুনাফা লাভের নিশ্চয়তা প্রকট হতে পারে। আবার একজন দরিদ্র শ্রমিকের কারো জীবন বাঁচাতে নিজের কষ্টের জমানো সামান্য টাকা দানও মহত্ত্বের প্রকাশ হতে পারে। সত্যিকারের মহত্ত্বকে কখনো চেপে রাখা যায় না। সূর্যের আলোর মতো তা জ্বলজ্বল করবেই। আপনা আপনি প্রকাশিত হবে। আর লোক দেখানো মহত্ত্ব কিংবা মহত্ত্বের ভান লোকের চোখে ধরা পড়ে যায়। কেউ যদি মানুষের ছোট বড় বিপদে এগিয়ে আসে, তাকে সাহায্য করে, নিজের সাধ্যমতো অন্যের ভালো করতে চায়, অন্যের প্রতি উদার হয়, মানুষকে ভালোবাসে তাহলে ব্যক্তির এই সকল আচরণের মধ্য দিয়ে তার মহত্ত্ব প্রকাশ পায়।
মহৎ মানুষের দৃষ্টান্ত: পৃথিবীতে মহৎ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি না হলেও খুব অল্পও নয়। অনেক মানুষের মধ্যে মহত্ত্ব এখনো বিরাজমান বলে এই পৃথিবী আজও টিকে আছে। মাদার তেরেসা থেকে বেগম রোকেয়া, হাজী মুহম্মদ মহসীন থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধী থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা প্রত্যেকেই তাদের মহত্ত্বের কারণে স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে আছেন। তারা সবাই মানব সেবায় জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। মাদার তেরেসা যেমন মানব সেবাকে নিজের ধর্ম হিসেবে নিয়ে সারাজীবন আর্তপীড়িতের সেবায় কাটিয়েছেন। তেমনি রক্ষণশীল সমাজে থেকেও বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার জন্য কাজ করে গেছেন। নিজের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন মেয়েদের স্কুল। হাজী মুহম্মদ মহসীন তার বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির সমস্তই দান করেছিলেন দেশের সকলের শিক্ষার জন্য। চিত্তরঞ্জন দাস নিজে সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, আবার নিজের আয়ের অর্থদান করেছেন হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য। মহাত্মা গান্ধী নিজের মহত্ত্ব দিয়ে সকলকে শুনিয়েছেন অহিংসার বাণী। নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের মঙ্গলের জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য গোটা জীবন জুড়েই যুদ্ধ করে গেছেন। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন নির্বাসনে। তবুও ম্লান হয়নি তার মহত্ত্ব। এভাবেই যুগে যুগে আবির্ভাব ঘটে মহৎ মানুষদের। যারা নিজেদের মহত্ত্ব দিয়ে চির স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন।
উপসংহারহ: মানুষের জীবনের সার্থকতা হলো সমাজ ও সমাজের মানুষের কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করা। সারাজীবন নিজেকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত রাখতে পারা। যে সমাজে সে বেড়ে ওঠে সেই সমাজ, দেশকে সে প্রতিদান দিতে পারে। মানুষের মহত্ত্ব ও মানবতা সমাজকে এবং মানব জীবনকে উন্নত করে। মহৎ ব্যক্তিরা তাদের মহত্ত্ব দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি জীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে তোলেন। তাই সকলের কাছেই মহত্ত্ব খুবই কাক্সিক্ষত একটি গুণ।
No comments