50. জনসেবা

ভূমিকাঃ মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই মানুষ কখনও মানুষ হয় না। সত্যিকার মানুষ হওয়ার জন্য মানুষকে অর্জন করতে হয় মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য যে ব্রত মানুষকে অবশ্যই পালন করতে হয়তার মধ্যে জনসেবা অন্যতম। আত্মস্বার্থমগ্নতামানুষের চরিত্রের এক ভয়ানক খারাপ গুণ। যেহেতু মানুষ সমাজবদ্ধ জীবসে কারণেই প্রতিটি মানুষ একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা থেকেই মানুষ বরাবরই একে অন্যের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছে। আর এই চেষ্টাই বৃহৎ পরিসরে জনসেবা হিসেবে রূপ নেয়। মানব ইতিহাসে মনুষ্যত্বের পতাকা স্থাপনের দৃষ্টান্ত মহামানবরা জনসেবার মাধ্যমেই রেখেছেন। জনসেবা সমাজজীবনে আনে স্থীতিশীলতাআর ব্যক্তিজীবনে আনে অনাবিল শান্তি।
জনসেবা স্বরূপ বৈশিষ্ট্যঃ সুপ্রসিদ্ধ সমাজবিজ্ঞানী রাস্কিন এর মতেপৃথিবীতে মানুষের কর্তব্য কর্ম তিনটি। "Duty towards God, Duty towards parents, and duty towards mankind". সুতরাং মানব কল্যাণের জন্য মানুষ যে কর্তব্য পালন করে তাই হলো
জনসেবা। মানুষের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে যেকোনোঅবদান রাখা বা বিশেষ ভূমিকা রাখাই জনসেবা বলে গণ্য করা যায়। শুধুমাত্র দুঃস্থপঙ্গুদরিদ্র মানুষের সেবাই জনসেবা নয়কল-কারখানা স্থাপনকিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে মানুষের কাজের সুযোগ করে দেয়াঅথবা এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে লোকজনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করাও জনসেবারই অন্তর্গত।
জনসেবাই ঈশ্বরের সেবাঃ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- বহুরূপ সম্মুখে ছাড়িকোথা খুজিছ ঈশ্বর। জীবে প্রেম করে যেই জনসেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ এই পৃথিবীতে রয়েছে ছোট-বড়ধনী-গরীবসবল-দুর্বলঅনাথ-পঙ্গুনানা রকম মানুষের সংমিশ্রণ। মহানবী (স.) বলেছেন- মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠযিনি মানুষের উপকার করেন।’ জনসেবার মধ্য দিয়েই মহাপুরুষদের পরিচিতি ঘটেছে যুগে যুগে। প্রত্যেক ধর্মের প্রবর্তকরাই জনসেবা বা মানবসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জন করার কথা বলেছেন। মূলত জনসেবাই ঈশ্বর সেবার আরেক রূপ।
সেবাব্রতের প্রাচীন ইতিহাসঃ কবি চন্ডিদাস বলেছেন- সবার উপরে মানুষ সত্যতাহার উপরে নাই।’ এই সত্যকে অন্তরে ধারণ করে অনেক মহামানব সেবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। জীবজগতের দুঃখ দূর করার ব্রত নিয়ে গৌতম বুদ্ধ ত্যাগ করেছিলেন রাজসিংহাসন। মহানবী (স.) বলে গেছেন সব কাজের মধ্যে সমাজ কল্যাণের কাজই শ্রেষ্ঠ।’ মাদার তেরেসার কথা আমরা সকলেই জানি। নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জনসেবা করেছেন। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলও এমন এক মহীয়সী নারী যিনি জনসেবা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করেছিলেন অকাতরে। বিবি খাদিজা তার অঢেল সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন দিন-দরিদ্রদের মধ্যে। এমন জনসেবার উদাহরণ ইতিহাসে অগণিত।
নানা রূপে জনসেবাঃ জনসেবার রয়েছে অনেক প্রকারভেদ। মানবকল্যাণে অর্থ ব্যয়শ্রম ব্যয়অসহায়ের পাশে দাঁড়ানোঅশিক্ষিতকে শিক্ষা দান করা সবই জনসেবা। কবি রজনীকান্ত সেনের কবিতায় আমরা জনসেবার প্রায় সবগুলো দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
অন্নহীনে অন্নদানবস্ত্র বস্ত্রহীনে,
তৃষাতুরে জল দানধর্ম ধর্মহীনে,
মুর্খজনে বিদ্যাদানবিপন্নে আশ্রয়,
রোগীরে ঔষধ দানভয়ার্তে অভয়,
গৃহহীনে গৃহদানঅন্ধেরে নয়ন
পীড়িতে আরোগ্যদানশোকার্তে সান্তনা,
স্বার্থশূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান,
স্বর্গের দেবতা নহেদাতার সমান।
নিঃস্বার্থ সেবাই মনুষ্যত্বঃ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এটি শুধু মুখে মুখে নয়একথা নিহিত থাকতে হবে প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরে। মনুষ্যত্ববোধই মানুষের মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি করেসেবা ব্রতে আগ্রহী করে তোলে। শুধুমাত্র নিজের পুত্র-কন্যাসংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকাই মানব জীবনের একমাত্র কাম্য হতে পারে না। আত্মনিমগ্ন জীবন কখনও সার্থকতা ও পরিপূর্ণতা পেতে পারে না। তাইতো রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
স্বার্থমগ্নযে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে,
সে কখনও শেখেনি বাঁচিতে।
জনসেবার গুরুত্বঃ জনসেবা এমনই এক ব্রত যা পৃথিবীতে একের সাথে অন্যের বন্ধন সৃষ্টি করে। সুখ-দুঃখঅভাব-অনটনমৃত্যুশোকহতাশা সবকিছুর সংমিশ্রণেই মানুষের জীবন। আর এ সকল সমস্যা থেকে মানুষই মানুষকে উদ্ধার করতে পারে। আর উদ্ধারের একমাত্র পথ হলো জনসেবা। জনসেবা সমাজে সৃষ্টি করে ভ্রাতৃত্ববোধ। এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা আনায়নে ভূমিকা পালন করে। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ একে অন্যের পাশে দাঁড়ায় এই জনসেবাকে কেন্দ্র করেই। যে মানুষ অন্য মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারেতার জীবনই সার্থক ও সফল হয়। কবি কামিনী রায়ের ভাষায়-
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
জনসেবা ও সেবা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কঃ মানবসেবার অগ্রগতির সাথে সাথেসেবা প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদি সবই সেবা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্গত। এই সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান জনসেবাকে অনেক বেশি ত্বরান্বিত করেছে। মানবজাতির উন্নয়ন ও কল্যাণে,তৈরি হয়েছেএই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বর্তমান বিশ্বে জনসেবাঃ অতীত কালের জনসেবা এবং বর্তমানের জনসেবার মধ্যে আমরা কিছুটা তফাত দেখতে পাই। জীবনযাত্রার ধারা পরিবর্তনই এই সেবাকাঠামো পরিবর্তনের মূল কারণ। বর্তমান বিশ্বে প্রায়ইঝড়জলোচ্ছ্বাসবন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা জনসেবার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
ছাত্রজীবনে জনসেবাঃ ছাত্রজীবন হলো সকল সু-অভ্যাস ও সৎ গুণাবলী অর্জনের সবচেয়ে মোক্ষম সময়। এই সময়েই প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর উচিত ছোট ছোট জনসেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে নিজেদের জীবনে এই গুণের বিকাশ ঘটানো। এতে ভবিষ্যত জীবনে তারা আরও বেশি করে জনসেবামূলক কাজে অংশ নিতে পারবে।
উপসংহারঃ মহৎ হৃদয়বৃত্তি ও মানবধর্ম বলতে আমরা জনসেবাকেই বুঝি। জনসেবা মানুষের জীবনে অনাবিল সুখশান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারে। নিজেরদুঃখ দূর করার অন্যতম উপায় হলো অন্যের দুঃখ দূর করার চেষ্টা করা। কারণ কেউ পৃথিবীতে একা একা সুখী হতে পারে না। সমাজে প্রত্যেকের সত্যিকার সুখ-শান্তিসমৃদ্ধি তখনই আসে যখন সেই সমাজে জনসেবার সঠিক চর্চা হয়। জনসেবাই একটি সুখীসমৃদ্ধ,অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের জীবনে এই গুণের বিকাশ ঘটানো উচিত।

No comments

Powered by Blogger.