69. বাংলাদেশের সামাজিক উৎসব
উৎসব কীঃ কোনো সাম্প্রদায়িক বা পারিবারিক সমাবেশ থেকে আনন্দ লাভ করা গেলে সাধারণত তাকে
উৎসব বলা হয়। উৎসব বলতে তাই যেকোনো আনন্দময় অনুষ্ঠানকে বুঝায়। তবে ভিন্ন ভিন্ন উৎসবের আনন্দের রং ও রূপ ভিন্ন হয়। সর্বসাধারণ বা অনেক লোকের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি উৎসব পূর্ণতা লাভ করে। অনুষ্ঠানের উপলক্ষ্য ও চেতনার উপর ভিত্তি করে উৎসবকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন- ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, পারিবারিক উৎসব, জাতীয় উৎসব ইত্যাদি।
বাংলাদেশের সামাজিক উৎসবঃ বাঙালি জাতি সর্বদা উৎসবমুখর। সময়ভেদে তারা নানা উপলক্ষে নানা ধরণের উৎসবে মেতে থাকে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই এদেশের অধিবাসীদের উৎসবপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একটি অপূর্ব সংমিশ্রণ রয়েছে বাংলাদেশে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে মুসলিমদের ঈদ উৎসব, হিন্দুদের পূজা উৎসব, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বুদ্ধ-পূর্ণিমা ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় উৎসবগুলো এখন অনেকটা সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে কেননা বর্তমানে যেকোনো ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীন ভাবে পালিত হয় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সংগ্রামী চেতনা থেকে জন্ম লাভ করেছে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের মতো জাতীয় উৎসব। বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রূপ প্রকাশ পায় বৈশাখী উৎসব, নবান্ন, পৌষ-পার্বণ ও পিঠা উৎসবের মাধ্যমে। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর উৎসবের মধ্যে বৈসাবি উৎসব সবচেয়ে জাঁকজমক ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়াও রয়েছে নানা উপলক্ষে নানা ধরণের পারিবারিক উৎসব।
ঈদ উৎসবঃ মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ। তারা বছরে দুইবার ঈদ উদযাপন করে থাকে। একটি হচ্ছে ঈদ-উল-ফিতর আর অপরটি ঈদ-উল-আযহা। রমজান মাসে এক মাস রোজা পালনের পর ধর্মপরায়ণ মুসলমানেরা বিপুল আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ-উল-ফিতর পালন করে। একে অপরের খুশি ও আনন্দ ভাগাভাগি করার মাধ্যমে তারা তৈরি করে ভ্রাতৃত্বের দুর্বার একটি বন্ধন। এই ঈদের দুই মাস দশ দিন পর আসে দ্বিতীয় ঈদ অর্থাৎ ঈদ-উল-আযহা। এটি হচ্ছে ত্যাগের মহিমা প্রকাশ করার একটি উপলক্ষ। জিলহজ্ব মাসের দশম দিনে এই উৎসব পালিত হয়। উভয় ঈদ উৎসবই বাংলাদেশে ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। এ সময় ভেদাভেদ ভুলে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাকার হয়ে ভালোবাসা বিনিময় করে।
পূজা উৎসবঃ দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশে শরৎকালে দুর্গাপূজা পালন করা হয় প্রতি বছর। এ জন্য এ পূজাকে শারদীয় দুর্গাপূজাও বলা হয়। আশ্বিন মাসে আকাশে যে চাঁদ থাকে তার সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী এই তিনদিন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ষষ্ঠীর দিন ‘মায়ের বোধন’ উৎসব পালন করা হয়। সবচেয়ে বড় পূজা ‘সন্ধিপূজা’ পালন করা হয় অষ্টমী ও নবমীর মিলনক্ষণে। দশমীর দিন ধর্মীয় শোভাযাত্রার মাধ্যমে নিকটবর্তী পুকুর বা নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে শেষ হয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। হিন্দু ধর্মের পালনীয় উল্লেখযোগ্য পূজার মধ্যে আরো রয়েছে চৈতপূজা, রথযাত্রা উৎসব, জন্মাষ্টমী, স্বরস্বতী পূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালিপূজা ইত্যাদি। সকল পূজাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সাম্য ও মৈত্রীর বন্ধন আরো দৃঢ় করে।
বুদ্ধ পূর্ণিমা ও প্রবারণা উৎসবঃ বৌদ্ধ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব হচ্ছে বুদ্ধ-পূর্ণিমা। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে আগত এক মহামানবকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বুদ্ধপূর্ণিমা উৎসব। কোনো এক বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতে নেপালের লুম্বিনী শালবনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বুদ্ধদেব। পূণ্যস্মৃতি বিজড়িত এই দিনটিকে পরবর্তীতে গৌরবময় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘বুদ্ধ-পূর্ণিমা’ নামে পালন করে গোটা বৌদ্ধ সম্প্রদায়। প্রবারণা ও কঠিন চীবর দান হচ্ছে এই সমাজের আরো একটি পবিত্র উৎসব। প্রবারণা উৎসব হয় শরৎকালে।
বড়দিনঃ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর পালন করে তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। পশ্চিমা দেশগুলোতে এ দিনটি ‘ক্রিসমাস ডে’ নামে পরিচিত। যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এ দিন আনন্দভোগ ও উৎসব-ই পুরো আয়োজনের মূল বিষয়।
বৈশাখী উৎসবঃ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সাংস্কৃতির ঐতিহ্য বহনকারী সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব হচ্ছে বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা। প্রতি বছর ১লা বৈশাখে মহা ধুমধাম ও আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে উদযাপন করা হয় বৈশাখী উৎসব। পুরো বছরের দুঃখ-বেদনা পিছনে ফেলে নতুনের বার্তা নিয়ে আসে ১লা বৈশাখ। এ উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। দিনটি উদযাপনের মাধ্যমে বাঙালি তার প্রাচীন ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক প্রবাহকে ধরে রাখার প্রয়াস পায়। ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এদিন নতুন বছরের হিসাব চালু করা হয়। সার্বজনীন উৎসব হিসেবে বৈশাখী উৎসব সর্বশ্রেষ্ঠ।
নবান্ন ও পিঠা উৎসবঃ বাংলাদেশে অগ্রহায়ণ মাসে পালন করা হয় নবান্ন উৎসব। নবান্ন মূলত কৃষকদের আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। নতুন শস্য ঘরে তোলার আনন্দে সবাই উৎসবে মেতে উঠে। এরপরেই আসে পৌষ-পার্বণ তথা পিঠা উৎসবের উপলক্ষ। এ উৎসব এখনো বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সাথে মিশে আছে আনন্দের বার্তাবাহক হিসেবে। এছাড়াও পৌষ সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব।
স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উদযাপনঃ বাংলাদেশ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফসল। এ দেশের সোনার ছেলেরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করেছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। একই বছর ১৬ ডিসেম্বর তারা বীরত্বপূর্ণ জয় লাভের মাধ্যমে বিশ্বকে উপহার দেয় বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এ ২টি দিন বাংলাদেশিদের জীবনে অপরিসীম তাৎপর্য বহন করে। তাই ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে জাতীয়ভাবে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনঃ পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে ভাষার জন্য আন্দোলন করে মানুষ শহিদ হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষা। বাংলার দামাল ছেলেরা নিজ জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছিল তার স্মরণে প্রতি বছর পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে আয়োজন করা হয় মাসব্যাপী একুশে বইমেলা। তাছাড়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক এ দিবসটি বাংলাদেশের মানুষ মহা সমারোহে উদযাপন করে।
বৈসাবি উৎসবঃ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় উৎসবের নাম বৈসাবি। তিন প্রধান ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের তিনটি অনুষ্ঠানের প্রথম অক্ষর নিয়ে এই উৎসবের নামকরন ‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের বৈষ্ণু, মারমাদের সাংগ্রাই ও চাকমাদের বিজু উৎসবের সমন্বয়ে বৈসাবির আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের আগের দিন থেকে শুরু হয়ে পরের দিন পর্যন্ত এই উৎসব চলতে থাকে মোট তিনদিন। এ উৎসবের মাধ্যমে তারা একই সাথে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
পারিবারিক উৎসবঃ বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন ধরণের পারিবারিক উৎসব পালন করে থাকে। শিশু জন্মগ্রহণের পর আকিকা অনুষ্ঠান, খৎনা ইত্যাদি বাঙালি সমাজের চিরায়ত চিত্র। বিয়ে হচ্ছে সবচেয়ে বড় পারিবারিক উৎসব। আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রের হাতে কন্যাদান করার মাধ্যমে শেষ হয় বিয়ের আয়োজন। অনেক পরিবারে আবার প্রতি বছর জন্মবার্ষিকী, বিবাহবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করা হয়।
সামাজিক উৎসবের তাৎপর্যঃ বিনোদন মাত্রই মানুষের জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিনোদনের মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে মানুষের চিত্ত শিহরিত হয়। এতে মানসিকভাবে তারা সর্বদা সতেজ ও প্রাণবন্ত থাকার সুযোগ পায়। আর মানুষের সুস্থ বিনোদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে সামাজিক উৎসব। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় মানুষ দুঃখ ভুলে আনন্দে মেতে উঠে। উৎসব হচ্ছে মূলত মানুষের সামাজিক চেতনার আনন্দমুখর অভিব্যক্তি। উৎসব ব্যতিত সমাজের সকলের মিলনমেলা সম্ভব হয় না। মানুষে মানুষে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে সামাজিক উৎসবের বিকল্প নেই। মানবজীবনে তাই উৎসবের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক।
No comments