149. বাংলাদেশের নদ নদী
ভূমিকা:
“গানের ভাষায়-এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়, এ আমার দেশ
কত আনন্দ বেদনা মিলন-বিরহ সংকটে।”
-আবু জাফর
নদী ও বাংলাদেশ একই সূতোয় গাঁথা দুটি নাম। এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দেশে সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নদীগুলো। বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-
দ্বীপ, যার সৃষ্টি নদীবাহিত পলি জমাট বেঁধে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। এসব নদ-নদী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বৈচিত্র্য দান করেছে। বলতে গেলে এ নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। সে জন্যই নদীর সাথে বাঙালির রয়েছে নাড়ীর টান।
বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থা: বাংলাদেশের নদীগুলোর অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে প্রবাহিত। মোট প্রায় ২৪,১৪০ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে বাংলাদেশের নদীগুলো ৪টি নদী প্রণালী বা নদী ব্যবস্থায় বিভক্ত। যথা:
১। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ২। গঙ্গা-পদ্মা ৩। সুরমা-মেঘনা ও ৪। চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদীসমূহ।
গঠন ও প্রবাহ বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশের নদীগুলো কয়েকটি ভাগে বিভক্ত যথা:- প্রধান নদী, উপনদী, শাখা নদী, স্বাধীন নদী ও নদী মোহনা। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীগুলোর উৎপত্তি ভারত।
বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী: অধিক সংখ্যক নদী থাকার কারণে বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। এজন্য এদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির উপর নদীর প্রভাব রয়েছে। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। এ নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখা নদী রয়েছে। নিম্নে প্রধান নদ-নদীর বর্ণনা দেয়া হলো-
পদ্মা: বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী পদ্মা। এর দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কি.মি.। এটি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্যদিয়ে গঙ্গানদী পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পদ্মা নদী রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার দৌলদিয়ায় যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। এছাড়া চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কুমার, গড়াই, ভৈরব, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, চিত্রা ইত্যাদি পদ্মার প্রধান শাখা নদী। পদ্মার উপনদীগুলো হলো মহানন্দা, নাগর নদী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন এবং কুলিখ।
মেঘনা:ভারতের মনিপুর রাজ্যের নাগা মনিপুর পাহাড়ের পাদদেশে মেঘনা নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তি স্থলে এর নাম বরাক। বরাক নদীটি বাংলাদেশের অদূরে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানার ভিতর দিয়ে পৃথকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কালনী হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে। এরপর চাঁদপুরে পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে আরও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মনু, খোয়াই মেঘনার প্রধান শাখা নদী এবং গোমতী, তিতাস, ডাকাতিয়া মেঘনার উপনদী।
ব্রহ্মপুত্র: এ নদ হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে তিব্বতের উপর দিয়ে পূর্ব দিকে ও পরে আসামের ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। অতঃপর ব্রহ্মপুত্র কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা ও তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের প্রধান উপনদী এবং বংশী ও শীতলক্ষ্যা প্রধান শাখা নদী।
যমুনা: যমুনা নদী তিব্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্রের শাখা যমুনা নদী নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে দৌলতদিয়ার কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। করতোয়া ও আত্রাই যমুনার প্রধান উপনদী। যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরী আর ধলেশ্বরীর শাখা নদী বুড়ি গঙ্গা।
নদী ও কৃষি: কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের চাষাবাদ ব্যবস্থা অনেকটাই নদীর সেচ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কেননা আমন ধান কাটার পর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজতলা তৈরি করে ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে বোরো ধান রোপণ করা হয়। এ সময় বোরো মৌসুমে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না বিধায় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জোয়ারের সময় নদীর পানি দিয়ে সেচ প্রদান করা হয়। এজন্য কৃষির উন্নয়নে নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নদী ও শিল্প: বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলো বিভিন্নভাবে নদীর পানি ব্যবহার করে। এছাড়া নদী পথে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় শিল্প কারখানা নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে।
মৎস্য সম্পদ: নদীমাতৃক এ দেশটি স্মরণাতীতকাল থেকে মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধশালী। আর তাইতো বাঙালিকে বলা হত ‘মাছে ভাতে বাঙালি।’ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মৎস্যখাত ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ছিল ৫.৫২ শতাংশ। বাংলাদেশে নদীতে ইলিশ, পাঙাশ, রুই, কাতলা, বোয়াল, পাবদাসহ বিভিন্ন ধরণের মাছ পাওয়া যায়।
নৌ চলাচল ও পরিবহন: নদী পরিবহন সবচেয়ে সস্তা ও সহজ পরিবহন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নদী পরিবহন দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে ২টি প্রধান সমুদ্রবন্দর রয়েছে চট্টগ্রাম ও মংলায়। ইওডঞঈ দেশের ৬০০০ কি.মি নৌপথে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে থাকে। নদী পথে পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার প্রভৃতি পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জল বিদ্যুৎ উৎপাদন: বাংলাদেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী নদীতে অবস্থিত যা কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে পরিচিত। খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে ১৯৬২ সালে স্থাপিত এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৫টি ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। এ কেন্দ্রটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সামান্য হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নদী ও যোগাযোগ ব্যবস্থা: নদী পথে সুলভে যাতায়াত করা যায়। বাংলাদেশে সারাবছর নৌ চলাচল উপযোগী নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫২২১ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৪৩৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশে বর্তমানে ২২টি নদী বন্দর রয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ প্রধান নদীবন্দর যেটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এছাড়া অসংখ্য নদীর উপর রয়েছে সুদৃশ্য সেতু। যেমন বঙ্গবন্ধু সেতু যা যমুনা নদীর উপর অবস্থিত। এটি বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম সেতু। তাছাড়া নির্মিতব্য পদ্মা সেতু তৈরি হলে এটি হবে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সেতু যার দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি.। এছাড়া খানজাহান আলী সেতু, লালনশাহ সেতু উল্লেখযোগ্য।
নদী ও বাংলা সাহিত্য: নদীকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি। সুদূর ফ্রান্সে বসে মাইকেল মধুসূধন দত্ত লিখেছেন-
সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
বহু দেশ দেখিয়াছি, বহু নদজলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে
নদীকে কেন্দ্র করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছেন ‘কর্ণফুলী’। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মাবোটে বসে লিখেছিলেন ‘সোনার তরী’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি। তাছাড়া নদীর কথা আসতেই এই গানটি মনে পড়ে যায়-
ও নদীরে একটা কথা সুধাই শুধু তোমারে. . .
কোথায় তোমার দেশ তোমার নাইকি চলার শেষ।
উপসংহার :
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
সত্যিই বাংলাদেশ এমনি বৈচিত্র্যেভরা। এই দেশে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদী। এসব নদী মাতৃভূমিকে করেছে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। তাই ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আজ অনেক নদী মারাত্মক দুষণের শিকার। পানির অভাবে অনেক নদী মৃতপ্রায়। সুতরাং নদী রক্ষায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে বিপন্ন হারিয়ে যাওয়া, মৃতপ্রায় নদীগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। কেননা নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, বাঁচবে দেশের মানুষ।
No comments